ঋতা চট্টোপাধ্যায় আধুনিক সংস্কৃত সাহিত্যে এক বিশিষ্ট নাম। জন্ম হয়েছিলো ১৯৫২ সালে, উত্তর কলকাতার এক বনেদি পরিবারে। খুব মেধাবী ছাত্রী ছিলেন। বিদ্যালয় স্তরে এবং উচ্চ শিক্ষাতেও বিশেষ কৃতিত্ব স্থাপন করেছিলেন। বেথুন কলেজ থেকে সংস্কৃত অনার্স, কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে প্রথমে এম.এ এবং পরে পি.এইচ.ডি ডিগ্রি লাভ করেন। কর্মজীবন শুরু করেন উইমেন্স কলেজ ক্যালকাটা (১৯৮০-৯৫) থেকে। তারপর রবীন্দ্রভারতী(১৯৯৫-২০০২) শেষে যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয় (২০০২-২০১৭) থেকে অবসর গ্রহণ করেন। বিশ্ববিদ্যালয় অনুদান আয়োগ(University Grants Commission/UGC) থেকে এমিরিটাস্ ফেলো হিসেবে নিযুক্ত হয়েছিলেন (২০১৭-১৯)। তাঁর প্রতিভার সৌরভ দেশের গন্ডী অতিক্রম করে বিদেশে পৌঁছেছিলো। বিদেশের একাধিক বিশ্ববিদ্যালয়ে বক্তৃতা দিয়েছেন। ২০০৮-০৯ সালে আয়ুর্বেদে গবেষণার জন্য ষোলো হাজার মার্কিন ডলার পুরস্কার পেয়েছিলেন। পরিচিতির জগত ছিলো বিরাট। প্রসিদ্ধ ও খ্যাতনামা অধ্যাপকদের সাথে তার ব্যক্তিগত আলাপচারিতা ছিলো। তাঁর অধীনে বহু গবেষণা হয়েছে। বহু অজানা বিষয় তিনি জগতের সামনে তুলে ধরেছেন। অনেক গবেষণাপত্রের পরীক্ষক ছিলেন। তাঁর স্নেহধন্য ছাত্রছাত্রীরা আজ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে যুক্ত।
গবেষণা প্রসূত পুস্তকের সংখ্যা একাধিক (চব্বিশের বেশি)। কয়েকটির নাম উল্লেখ করা হলো-
১. বিদুষী বঙ্গনারী রমা চৌধুরী
২. শতবর্ষে কবি নিত্যানন্দ ৩. পণ্ডিত শ্রীজীব ন্যায়তীর্থের সারস্বত সাধনা ৪. G B Palsule ৫. সীতানাথ আচার্য, কবি ও প্রাবন্ধিক ৬. মহামহোপাধ্যায় হরিদাস সিদ্ধান্তবাগীশের সারস্বত সাধনা ৭. সিদ্ধেশ্বর চট্টোপাধ্যায় (বুড়োদা) ৮. 20th Century Sanskrit Literature A glimpse into Tradition and Innovation ৯. আধুনিক সংস্কৃত কাব্য ঃ বাঙালী মনীষা শতবর্ষের আলোকে ১০. আধুনিক সংস্কৃত সাহিত্য(১৯১০-২০১০) : ছোটগল্প ও নাটক।
মৃত্যুর কিছু দিন পূর্বে তিনি একটি সংকলনগ্রন্থ প্রকাশ করেন। নিত্যানন্দের নামাঙ্কিত এই গ্রন্থে নিত্যানন্দ বিষয়ক রচনা ছাড়া ও আরো কয়েকটি রচনা স্থান পেয়েছে। সংকলনগ্রন্থের নাম, Nityananda Smrititirtha (1923-2008) A Century Commemoration Volume.
বেশ কিছু পুরস্কার পেয়েছিলেন।
গ্রিফিথ মেমোরিয়াল প্রাইজ (১৯৮১)ইত্যাদি। তিনি কোরিয়ার পস্কো দ্বারা নির্বাচিত ভারতীয় ফেলো। সি.আই. আই.এল্ ফেলো ইত্যাদি সম্মান পেয়েছিলেন।
কলকাতার দীনেন্দ্রনাথ স্ট্রীটে বিরাজমান সংস্কৃত সাহিত্য পরিষদের আজীবন সদস্যা ছিলেন। পরিষদের জন্য নিঃসন্দেহে বহু কাজ করেছিলেন।
ব্যক্তিগত আলাপচারিতা থেকে জানা যায়, পণ্ডিত কালিদাস ভট্টাচার্যের কাছে তিনি বিদ্যাভ্যাস করতে যেতেন। সংস্কৃত কলেজের বিষ্ণুপদ চক্রবর্তী, ভাটপাড়া টোলের প্রথিতযশা পণ্ডিত শ্রীজীব ন্যায়তীর্থ, বর্ধমান বিশ্ববিদ্যালয়ের সিদ্ধেশ্বর চট্টোপাধ্যায়, হাওড়া সংস্কৃত সাহিত্য সমাজের প্রতিষ্ঠাতা নিত্যানন্দ মুখোপাধ্যায়, রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বনামধন্যা উপাচার্যা রমা চৌধুরী, কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের আশুতোষ অধ্যাপক সীতানাথ আচার্য প্রমুখদের সাথে তাঁর সুসম্পর্ক ছিলো।
সেই সব প্রাতঃস্মরণীয় পণ্ডিত ব্যক্তিবর্গ( মূলতো পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যের) যাঁরা শিক্ষা বিস্তারে ও সারস্বত চর্চায় উল্লেখযোগ্য স্থান অধিকার করেছিলেন, তাঁদের প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়েছিলেন অধ্যাপিকা চট্টোপাধ্যায়।
একাধিক গ্রন্থে, পত্রিকায় তার সেই সব রচনা প্রকাশিত হয়েছে।
তার গ্রন্থরাজির মধ্যে থেকে শতবর্ষে কবি নিত্যানন্দ (১৯২৩-২০০৮) শীর্ষক গ্রন্থ সম্বন্ধে কয়েকটি কথা আলোচনা করা হলো।
২০২১ সালের প্রজাতন্ত্র দিবস অর্থাত্ ২৬শে জানুয়ারি গ্রন্থ টি সংস্কৃত পুস্তক ভান্ডার থেকে প্রথম প্রকাশিত হয়। গ্রন্থ টিতে একশ’ আঠাশ ( ১২৮ ) টি পৃষ্ঠা আছে। প্রচ্ছদ অঙ্কন করেছিলেন, সুযোগ্যা কন্যা ড সৌম্যনেত্রা চট্টোপাধ্যায় মুন্সী। উতসর্গ করেছিলেন নিজের আদরের নাতনি কে। পরিবারের গুরুত্ব সর্বাধিক ছিলো অধ্যাপিকা ড ঋতা-র কাছে, তা বলাই বাহুল্য। গ্রন্থে পাঁচটি অধ্যায় আছে।
সূচীপত্রের প্রথমে সংকেতসূচী, নিত্যানন্দ-প্রশস্তিঃ, প্রাগ্ভাষ থেকে বংশ তালিকা সব কিছুর উল্লেখ আছে।
প্রথম অধ্যায়ের বিষয় হলো কবির ব্যক্তিজীবন ও সারস্বত চর্চা।
দ্বিতীয় অধ্যায়ে অধ্যাপিকা ঋতা অধ্যাপক নিত্যানন্দ মুখোপাধ্যায়ের সুবিশাল রচনাশৈলীর বিষয় আলোচনার মাধ্যমে বিন্দুতে সিন্ধু দর্শন করিয়েছেন।
তৃতীয় অধ্যায়ের বক্তব্য বিষয় কবির কাব্যকৃতি।
চতুর্থ অধ্যায়ে নিত্যানন্দ কৃত প্রবন্ধাদির উল্লেখ ও সম্পাদনা বিষয়ে সমালোচনা করেছেন।
পঞ্চম অধ্যায়ে নিত্যানন্দের বাচনরীতি বিষয়ে মনোজ্ঞ আলোচনা করে উপসংহার ঘোষণা করেছেন। এরপর প্রসঙ্গ কথা, সূক্তি, নির্বাচিত সহায়ক গ্রন্থপঞ্জী, নির্ঘন্ট সবশেষে চিত্রসূচীর মাধ্যমে গ্রন্থের সমাপ্তি হয়েছে। আকারে ক্ষুদ্র হলেও গ্রন্থের বক্তব্য শাশ্বত ও সুদূরপ্রসারী। কবি নিত্যানন্দের জীবন ও কার্যাবলী এর মধ্যে দিয়ে মূর্ত হয়ে উঠেছে। অধ্যাপিকা পূর্বে এই বিষয়ে বিভিন্ন পুস্তকে সংক্ষেপে আলোচনা করলেও এটি প্রথম নিত্যানন্দ সম্পর্কিত বাংলা ভাষায় রচিত পূর্ণাঙ্গ গ্রন্থ।
নিত্যানন্দ মুখোপাধ্যায় আধুনিক সংস্কৃত সাহিত্যের ইতিহাসে এক উজ্জ্বল নাম। প্রাচীন আদর্শ, পরম্পরা ও আধুনিক মনস্কতা একত্রে গঠিত হয়েছিলো কবির রচনার প্রেক্ষাপট।
ঋতা চট্টোপাধ্যায়ের আধুনিক সংস্কৃত সাহিত্যে বিশেষ অবদান ছিলো। সমসাময়িক ক্ষেত্রে যাঁরা বিভিন্ন বিষয়ে মৌলিক রচনা সৃষ্টি করেছিলেন, সেগুলো তিনি সংগ্রহ করেছিলেন। যথাযোগ্য মর্যাদায় ও সমাদরের সাথে সেগুলো সাজিয়ে তুলে দিলেন উত্তরসূরীদের হাতে।বিশেষ তো তিনি যোগসূত্রের কাজ করেছিলেন অতীতের সঙ্গে আধুনিকের। যে সব মণিমুক্তা বিচ্ছিন্ন হয়ে অবস্থান করছিলো, তাঁদের তিনি সযত্নে গাঁথলেন। সূত্রস্য মে গতিঃ। তাঁর গ্রন্থগুলি এক অর্থে জীবন্ত দলিল। সত্তর-আশির দশকের সংস্কৃত সাধকদের কথা বাংলা ও ইংরেজি উভয় ভাষাতেই প্রকাশিত হয়েছে। তাঁদের মধ্যে অনেকেই প্রীতি বশতঃ অধ্যাপিকা চট্টোপাধ্যায় কে শুভেচ্ছা জানিয়েছিলেন। গ্রন্থে তাঁদের কথা উল্লেখ করেছেন।
* সহকারী অধ্যাপক, বিবেকানন্দ কলেজ, ঠাকুরপুকুর, কলকাতা
Seth Bagan Adarsha Vidyamandir (H. S.) Govt. Sponsored School.
Ritadi is my sister’s sister-in-law. Both are no more now. I first met Ritadi in my uncle’s house in Salt Lake when my brother-in-law Rupakda had come to meet my sister along with a few family members. It should be noted that I am 9 years younger to my sister born and brought up in Sindri, Dhanbad and hardly aware of the ways marriages were fixed up. Everything seemed new to me.
Anyway that day I heard Ritadi sing beautifully Rabindrasangeet. What struck me that day was that Ritadi sang not only because she could sing well but to make my sister feel comfortable as she too had to sing.
One big lesson learnt – make people comfortable when they are being judged. It was coincidence that after we settled down in Salt Lake in 1984 one of her vocal guru Sri Khokon Mazumdar was also my guru for sometime.
Throughout the wedding period we met often and Ritadi made each of us feel special. From then on I found a pattern in her enchanting ways – she would enquire about all our family members. Lesson learnt – and I think I do that spontaneously now.
That she was a scholar is known to all. When I did my class 11 and 12 from Bethune College I saw her name etched in the huge board. Her scholarly graph went up in leaps and bounds. Her switch from College to University then as Emeritus Professor makes us all proud. Every now and then heard about books being written by her, guiding research scholars, reading of papers in many seminars, being invited abroad to give lectures – she was passionate about her subject and I am sure she has left an indelible mark in the history of modern Sanskrit. I was highly impressed with her house as the very living room had her study table with lots of books in the cupboard at the back. People like her are incredible.
She had a nice sense of dressing and her choice of sarees, the sleek jewellery made her look so poised. Her sweet smile was the cherry on the icing. With Rupakda and Didi in Ranchi our connection with them on landline was through Ritadi’s house. She was kind enough to arrange for talks with Rupakda and Didi from her house. Many important events , decisions were exchanged through her this way.
I heard Ritadi telling my mother that she got married to Sudiptoda when he was officially unemployed. At that time such decisions were almost unheard of. I wonder at the love, confidence and faith she had in him. Her love for her husband should be recorded in history of love marriages. I knew she would rue her visits abroad as she had be away from Sudiptoda. He on the other hand was so proud of Ritadi and he had his reasons too – beautiful wife, highly intelligent, great scholar, teacher, good singer, dignified lady with fine taste, and a wonderful social person. Sudiptoda would talk about her accomplishments with his eyes twinkling with well earned pride.
Ritadi’s love was so profound for Sudiptoda that she stood by his side throughout his suffering. And after he passed away I have never seen her join any social gathering. I have never seen anyone continue this for long. Her feelings were so deep that maybe she didn’t want to enjoy any social event alone.
Being an erudite person many of us would ask her to help out during baby naming ceremony. She willingly complied and suggested unusual names with such deep meanings. I liked hearing her address didi as ‘Boumoni’. It sounded musical and endearing.
Ritadi was the first person to inform me about my didi’s demise… she was crying and I was numb and shaking uncontrollably. Then began a new chapter. Ritadi took active role in getting Rumpa and Bubam admitted at Bharatiya Vidyabhavan.
I often met her in Purbachal then.
Her greatest tribute to Sudiptoda was through a formation of a trust to help needy and meritorious students for higher studies. It involves enormous workload. In her busy life with chronic ailments she undertook so much for this noble cause. Convergence has come a long way because of her.
Ritadi, was an affectionate person….her bond with her son-in-law was the same as with her daughter and grand daughter. She was a loving wife, mother, mother-inlaw and grand mother . She was proud of them all.
Before I wind up I must not forget to remember that she had gifted a Milton jug shaped small flask on my wedding. It was pristine white and stylish. It was our companion for many many years.
ম্যামের অকস্মাৎ জীবনাবসানের পর কনভারজেন্স-এর দায়িত্ব ম্যামের একমাত্র সুযোগ্যা কন্যা সৌম্যনেত্রা মুন্সী সাদরে গ্রহণ করেন। তাই কনভারজেন্স একদিনও মাতৃহারা হয়নি। ম্যাম্ নিজেও আমাদের অনেক সময় বলেছেন যে কনভারজেন্সের উত্তরসূরী হিসাবে ম্যামের পর গুড়িয়া দিদিই (সৌম্যনেত্রাদিকে ম্যাম্ এই নামে ডাকতেন) দায়িত্ব নেবে। দিদি ম্যামের পারলৌকিক কর্ম শেষ করেই কনভারজেন্স-কে সময় দিয়েছেন। জেনেছেন ম্যামের শুরু করা অথচ অসমাপ্ত কাজগুলোর অবস্থান সম্বন্ধে। আমাকে ম্যাম্ যেগুলো বলে গিয়েছিলেন আমি দিদিকে সব জানিয়েছিলাম। দিদি সর্বপ্রথম সেই কাজগুলো শেষ করার পরিকল্পনা নেয়। সর্বোপরি ম্যামের ইচ্ছা ছিল কনভারজেন্স লাইব্রেরীটা সর্বসাধারণের জন্য প্রস্তুত করে দেওয়া। বিভিন্ন কারণে সেটা বিলম্ব হতে থাকছিল। কিন্তু দিদি সর্বপ্রথম দায়িত্ব নিয়েই তিনমাসের মধ্যে খাতায় ক্যাটালগ্ করে কনভারজেন্স লাইব্রেরীকে সর্বসাধারণের জন্য খুলে দিয়েছিলেন। প্রথমে ভেবেছিলাম এতো কম সময়ে কিভাবে এটা সম্ভব কিন্তু দিদির পরিকল্পনা সেটাকে বাস্তবায়িত করেছিল। দেখেছি সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনাই কাজকে সঠিকভাবে এগিয়ে নিয়ে যেতে এবং সমাপ্ত করতে সক্ষম। কনভারজেন্স লাইব্রেরী খোলার পর থেকেই এটি সংস্কৃত জগতের অনেক দুষ্প্রাপ্য বইয়ের একমাত্র ভাণ্ডার হয়ে দাঁড়িয়েছে। খোলার প্রথম থেকেই অল্প হলেও প্রায় প্রতিটি দিনই দূর-দূরান্ত থেকে বিশেষতঃ শোধছাত্র-ছাত্রীরা কনভারজেন্স গ্রন্হালয়ে এসেছে এবং তাঁদের শোধবিষয়ের সন্ধান পেয়েছে। এমনকি গ্রীষ্মের দাবদাহ যাতে পড়ায় কোন বিঘ্ন না ঘটায় সেই জন্য বারবার বলেন এ.সি-টা যেন চালিয়ে নিই। ওনার এইরকম অনেক মহত্ত্ব ম্যামের মাতৃসম ব্যবহারকে স্মরণ করায়। লাইব্রেরীর দায়িত্বে থাকা আমি এবং যারা নিয়মিত এই লাইব্রেরীতে আসেন তারা দিদিকে জানেন তিনি কতটা আমাদের কাছের। কনভারজেন্স লাইব্রেরী শুরুর একমাসের মধ্যেই ক্যাটলগ্-টি টাইপ্ করে সহজেই বই সার্চ করার ব্যবস্থা করা হয়েছে। খুব শীঘ্রই আগত ছাত্র-ছাত্রীরা নিজেরাই সার্চ করে গ্রন্হের বিবরণ জানতে পারবে এই ব্যবস্থা হচ্ছে। আগামী দিনে আধুনিক সংস্কৃত সাহিত্যের একটি বড় রত্নভাণ্ডার হতে চলেছে এই কনভারজেন্স লাইব্রেরী। যেখান থেকে বিশেষতঃ শোধছাত্র-ছাত্রীদের তাঁদের শোধবিষয় আহরণ করতে পারবে। ম্যামের লেখা বা সম্পাদিত গ্রন্হের সংখ্যা ২৮ টি। যেগুলির বেশ কয়েকটাই বর্তমানে পুনর্মুদ্রণের অভাবে দুষ্প্রাপ্য। সেগুলির সবকটিই এই লাইব্রেরীতে যত্ন সহকারে রাখা আছে। অনেক দুষ্প্রাপ্য বই এই গ্রন্হালয়ে থাকায় এটি মূলতঃ রেফারেন্স লাইব্রেরী হিসেব ব্যবহারযোগ্য। অর্থাৎ এখান থেকে কোন বই ইস্যু হয় না। আগত ছাত্র-ছাত্রীরা এসে পড়াশোন করতে পারে সেই ব্যবস্থা করা আছে। এমনকি বিভিন্ন রিসার্চ জার্নালের সম্ভারও বটে এই কনভারজেন্স লাইব্রেরী। ম্যামেরও বিভিন্ন সময়ে প্রকাশিত বিভিন্ন লেখা ও কাজ এখানে সুন্দরভাবে রাখা আছে। যেগুলিও একসাথে এককাছে পাওয়া প্রায় অসম্ভব। এই সমস্ত মহান্ কর্মের পিছনে আছে ম্যামের স্বপ্ন আর দিদির সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনা।
১) ভারতবর্ষের প্রাচীন ভাষা ও সাহিত্যবিষয়ক গবেষণা, পঠন ও পাঠনে নিয়োজিতপ্রাণ কিছু জার্মান ভারততত্ত্ববিদের সংক্ষিপ্ত জীবনী এবং ভারতীয় সাংস্কৃতিক জীবনে তাঁদের অবদান নিয়ে সূত্রপাত এই রচনার-
আধুনিক সময়ে প্রধানত: বাণিজ্যিক কারণে বেশী সংখ্যায় ইওরোপীয়দের ভারতবর্ষের মাটিতে পদার্পণের সঙ্গে সঙ্গেই এদেশ এবং এদেশের সংস্কৃতি সম্পর্কে তাঁদের উৎসাহ প্রবল আকারে দেখা দেয় । Switzerland, Austria এবং Germany র ভারতবর্ষের মাটিতে উপনিবেশ স্থাপনের কোন আকাঙ্ক্ষা না থাকলেও এইসব দেশের পণ্ডিতরা ভারততত্ত্বে প্রচুর অবদান রেখেছেন । ইওরোপে এই সব পণ্ডিতদের বিশেষ খ্যাতি ছিলো না । উনবিংশ শতকে Sir William Jones কৃত অভিজ্ঞানশকুন্তলা অনুবাদের জার্মান তর্জমা প্রকাশিত হওয়ার পর ভারতীয় চিন্তাধারা ও সাহিত্যের প্রতি তাঁদের গভীর মুগ্ধতা দেখা দেয়। August Wilhelm von Schlegel এবং তাঁর ভ্রাতা Friedrich সংস্কৃত ভাষায় পারদর্শিতা লাভ করেন, ১৮১৮ সালে Bonn বিশ্ববিদ্যালয়ের ভারততত্ত্বের Chair Professor পদ স্থাপিত হলে প্রথম সংস্কৃত অধ্যাপকের পদে বৃত হ’ন August Wilhelm von Schlegel ৫১ বছর বয়সে। তিনি নিজের স্থাপিত ছাপাখানায় ল্যাটিন অনুবাদ সহ দেবনাগরী হরফে শ্রীমদ্ভগবদ্গীতা ছাপান। প্রুসিয়ান মন্ত্রী, বিশ্ববিদ্যালয়-গবেষক, ভাষাবিজ্ঞানী এবং দার্শনিক Wilhelm von Humboldt শ্রীমদ্ভগবদ্গীতা পাঠ করে গভীরভাবে প্রভাবিত হ’ন। ২ বছর পরে ১৮২০ সালে তাঁরই উদ্যোগে বার্লিন এ ভারততত্ত্বের দ্বিতীয় অধ্যাপকপদ সৃষ্ট হয় যেখানে Franz Bopp ঐ বিষয়ে প্রথম অধ্যাপক পদ অলঙ্কৃত করেন । মাত্র ২৫ বছর বয়সে তিনি সংস্কৃতের সঙ্গে ইন্দো-ইওরোপীয় ভাষাগুলির তুলনামূলক সম্পর্ক বিষয়ক গবেষণাপত্র রচনা করেন। এই Bopp তুলনামূলক ভাষাবিজ্ঞানের জনক বলে পরিগণিত হ’ন।
১৮৫২-৭৫ সালের মধ্যে সংস্কৃত ভাষা বোঝা ও অনুবাদের জন্য দুই প্রখ্যাত জার্মান পণ্ডিত O.von. Boehtlingk এবং R. Roth এর তত্ত্বাবধানে প্রস্তুত হয় বৃহদাকার St. Petersburg Dictionary, ইংরেজীতে অনূদিত হয়ে যেটি ভারতবর্ষে প্রকাশিত হয়েছে । পরবর্তিকালে ১৮৭৯-৮৯ সালের মধ্যে Boehtlingk সংস্কৃত-জার্মান সংক্ষিপ্ত আর একটি অভিধান প্রস্তুত করেন । ১৯৭৫ সালে নতুন অন্য একটি অভিধান প্রস্তুত করেন K. Mylius. বৌদ্ধ সংস্কৃতের অভিধান Goettingen বিশ্ববিদ্যালয় থেকে প্রকাশিত হয় G.von Simon এর সম্পাদনায়।
২) ভারতবর্ষ এবং জার্মানীর সাংস্কৃতিক সম্পর্ক ও বিদ্যাবিনিময়-
ভারতবর্ষের সঙ্গে জার্মান ভারততত্ত্ববিদদের সম্পর্কের কথা বলতে গেলে প্রথমেই নাম করতে হয় Heinrich Roth এর (১৬২০-১৬৬৮)। আগ্রার মুগল রাজসভায় তিনি ছিলেন একজন খৃষ্টান যাজক ও ধর্মপ্রচারক, ইওরোপীয়দের মধ্যে সর্বপ্রথম যিনি সংস্কৃত ভাষাশিক্ষা করেছিলেন এবং সংস্কৃতভাষার ব্যাকরণ প্রণয়ন করেছিলেন। দুবার সড়কপথে ভারতবর্ষে আসার জন্য তিনি বহু কষ্ট সহ্য করেন।
১৬১৮ থেকে ১৬৪৮ এই ‘ত্রিশ বছরব্যাপী যুদ্ধে’র গোড়ার দিকেই ১৬২০ সালের ১৮ ডিসেম্বর জার্মানীর Dillingen শহরে আইনজ্ঞ পিতার ঘরে তাঁর জন্ম হয়, ১৬৩৯ সালে তিনি খৃষ্টধর্ম বরণ করেন এবং এর ১০ বছর পরে ধর্মযাজক বৃত হ’ন । এক সুইডিস সেনার হাতে প্রায় মৃত্যুবরণের সম্মুখীন হয়ে অল্পের জন্য প্রাণে বেঁচে গেলে সুস্থ হয়ে ধর্মপ্রচারক (missionary) হওয়ার সিদ্ধান্ত নেন!
ইতালীর Livorno থেকে শুরু করে Turkey র Smyrna হয়ে পার্শিয়ার রাজধানী Isfahan এ পৌঁছান। ইথিওপিয়া তখন ক্যাথলিক ধর্মপ্রচারকদের কাছে নিষিদ্ধ থাকায় তিনি ১৬৫২ সালে গোয়ায় আসেন এবং সেখানে অন্য অনেক ভাষার সঙ্গে কন্নড়, Persian এবং উর্দু ও শেখেন। পরে আগ্রায় যান এবং খৃষ্টান একটি কলেজের প্রধান হ’ন। এখানেই সংস্কৃতভাষা শিখে ব্রাহ্মণ পণ্ডিতদের সঙ্গে বিদ্যাচর্চায় অবতীর্ণ হ’ন, পরে সংস্কৃতভাষার গুরুত্ব বুঝতে পেরে ১৬৬০ থেকে ১৬৬২ সালের মধ্যে সংস্কৃত ব্যাকরণ রচনা করেন যাতে পাণিনি ব্যাকরণশিক্ষার বিশেষ নৈপুণ্যের পরিচয় এবং বিশদ বিবরণ ছাড়াও ব্যাখ্যানভাগ আছে ল্যাটিনে। হাতে লেখা পুঁথি Rome এ নিয়ে যাওয়া হলেও সেটিকে প্রকাশযোগ্য করার মত সময় Roth এর হাতে না থাকায় সেটি কখনই প্রকাশিত হয়না যদিও বেশ কিছু পণ্ডিত এবং স্বয়ং Austria র সম্রাট সেটি প্রকাশ করতে ইচ্ছুক ছিলেন।
Roth সংস্কৃতভাষাকে মন দিয়ে পড়েছিলেন তাই শুধু নয়, সংস্কৃত সাহিত্য এবং ভারতীয় দর্শনে প্রগাঢ় পাণ্ডিত্য লাভ করেছিলেন, এ কথা বলেছেন আর এক খৃষ্টান পণ্ডিত Athnasius Kircher, যিনি Roth এর সঙ্গে সাহিত্যচর্চা করেছেন এবং Vatican Library তে Roth প্রণীত কিছু রচনার পাণ্ডুলিপি সংরক্ষিত করেছেন। এর একটি হলো ১৬৪৪ সালে লিখিত ছন্দোবদ্ধ একটি কোষ- বেণীদত্তের পঞ্চতত্ত্বপ্রকাশ এবং অপরটি পঞ্চদশ শতকের শেষদিকের দর্শনবিষয়ক নিষ্কর্ষ গ্রন্হ (compendium) বেদান্তসার । Roth এর অপর রচনা যা বিশেষ জনপ্রিয় ও পণ্ডিত মহলে সমাদৃত হয়েছিল ভগবান বিষ্ণুর দশ অবতারের ওপর প্রবন্ধ যেটি Kircher এর গ্রন্হ “China illustrata” গ্রন্হের একটি অধ্যায়!
৩) ১৬৬২ সালে দুজন খৃষ্টান ধর্মযাজক পিকিং (বর্তমান Beijing) থেকে Lhasa এবং কাঠমাণ্ডু হয়ে শীতের হিমালয়ের আবহাওয়ায় আগ্রায় পৌঁছলেন যাঁদের মধ্যে একজন পথশ্রমজনিত ক্লান্তিতে প্রাণত্যাগ করেন। ফলে সিদ্ধান্ত হয় যে অপর অভিযাত্রী Johannesburg Grueber এর সহযাত্রী হয়ে Rome এ যাবেন স্বয়ং Roth. এই Grueber ছিলেন পিকিং এর সভার জ্যোতির্বিজ্ঞানী যেখানে ১৩০৭ সালে Archbishop এর কার্যালয় স্থাপিত হয় এবং তিনিই সর্বপ্রথম তৎকালীন তিব্বতের নগর সভ্যতা এবং সংস্কৃতির বিষয়টি সর্বসমক্ষে আনেন। তিনি সড়কপথে পদব্রজে ৪০,০০০ কিমি অতিক্রম করে গুরুত্বপূর্ণ অভিযাত্রীর খ্যাতিলাভ করেন।
এই Grueber আর Roth সড়কপথে Rome যাত্রা করেন এবং এক বছরের অধিককাল পরে সেখানে পৌঁছান । তাঁদের বক্তব্যে ভারতবর্ষ থেকে চীনের যাত্রাপথ সমুদ্রপথের থেকে সড়কপথ বেশী পছন্দের ছিলো যা নাকি কর্তৃপক্ষ কর্তৃক রাজনৈতিক কারণে পরিত্যক্ত হয়, ৬০০ জন ধর্মযাজক যাঁরা পূর্বের দেশগুলোর উদ্দেশ্যে সমুদ্রপথে রওনা হয়েছিলেন মাত্র তাঁদের মধ্যে মাত্র ১০০ জন ১৬৯০ সালে তাঁদের গন্তব্যে পৌঁছোতে সক্ষম হ’ন বাকীরা জলদুস্য কবলিত হয়ে প্রাণ হারান, এতৎসত্ত্বেও পর্তুগীজদের পরিকল্পিত সমুদ্রপথই মনোনীত হয় । Roth এবং Grueber কে ভারতবর্ষে ফেরৎ পাঠানো হয় এবং পরে তাঁরা Persia যাওয়ার পথে রাশিয়ার মধ্যে দিয়ে রওনা হ’ন কিন্তু রাশিয়ার এক আন্দোলনের সম্মুখীন হয়ে তাঁদের Turkey তে ফিরতে হয় যখন Grueber ভগ্নস্বাস্থের জন্য Istanbul এ অবস্থান করেন এবং অবশেষে পরবর্তিকালে অবশেষে Rome এ পৌঁছান । বন্ধুকে বিদায় জানানোর আকস্মিকতায় Roth তাঁর গ্রন্হের পাণ্ডুলিপিগুলি সেখানে ফেলে যান এবং ওগুলো ওখানেই পোপের সংরক্ষণাগারে স্থান পায় এবং সম্প্রতিকালে সেগুলি প্রকাশ করার পরিকল্পনা করা হয়। Roth একলাই তাঁর যাত্রা অব্যাহত রাখেন এবং Turkey, Armenia এবং Persia র মধ্যে দিয়ে অবশেষে ১৬৬৬ সালে আগ্রা এসে পৌঁছোন যেখানে ২ বছর পরে তিনি দেহত্যাগ করেন॥
কৃতজ্ঞতা : STACHE-ROSEN, VALENTINA. GERMAN INDOLOGISTS. INDIA: DIALOGUE, 1980.
প্রাচীনকাল হতে ব্রহ্মবিন্দর সম্বন্ধে স্পর্শকাতর ছিল সমাজ। মুখ থেকে বেরিয়ে আসা জলকণা পাশাপাশি অবস্থানকারীদের কাছে ছড়িয়ে পড়তে না পারে তার ব্যবস্থা সম্বন্ধে ওয়াকিবহাল ছিল তারা। তখনও ভাবা হতো এই জলকণা অন্যদের ক্ষতি করতে পারে। শুধু তাই নয় দেবতাদের পূজার্চনায় ও ভোগ নিবেদনের সময় খুব সতর্ক থাকতেন। যিনি ভোগ রন্ধন করতেন, তিনি মুখ ও নাক ঢেকে রন্ধনাদির কাজ করতেন।এমন কি যিনি ভোগ বহণ করে দেবতার কাছে পরিবেশন করতেন, তিনিও মুখ ও নাক ঢাকা রাখতেন, মুখের জলকণা ও নাকের দ্বারা ঘ্রাণ গ্ৰহণ যাতে করতে না পারেন। কথিত আছে—‘ ঘ্রাণেন অর্ধভোজনম্’ তাই নাক চাপা দিতেন। এমনকি ভোগ নিবেদনের সময়ও পূজক ভোগ হতে নির্দিষ্ট দূরত্বে অবস্থান করতেন বা নিবেদনের আগে ঘ্রাণ নাক পর্যন্ত না যায় , সেভাবে অবস্থান করতেন।
যজ্ঞের হোমাদি সম্পাদনের সময় ব্রহ্মবিন্দর সম্বন্ধে হোতারা সতর্ক থাকতেন । অগ্নি প্রজ্বলনের পর ইন্ধনের চাপে অগ্নি নিভে আসত।,তখন সরাসরি ফুঁ দিয়ে অগ্নি প্রজ্বলন করা যেত না বা যজ্ঞ চলাকালীন হোমাগ্নিতে জল বা জলকণা দেওয়া যেত না। তারজন্য দুহাত মুক্ত অঞ্জলির মতো করে ফুঁ দিতে হয়, হাতের মুক্ত অঞ্জলিতে ধাক্কা খেয়ে ফুঁ বাতাস অগ্নি প্রজ্বলনে সাহায্য করত।এই ফুঁ এর সঙ্গে জড়িত জলকণা (ওয়াটার ড্রপ লেট) বা ব্রহ্মবিন্দর হাতে আটকে যেত , আর শুধু বাতাস অগ্নি প্রজ্বলনে সহায়ক হত। এই ‘ওয়াটার ড্রপ লেট’ হল সাধু ভাষায় ব্রহ্মবিন্দর। এ বিষয়ে একটি পুরাতাত্ত্বিক ঘটনার অবতারণা করা যেতে পারে। দ্বাপর যুগে যখন রাজা নন্দের জায়া যশোদা দেবী যশোদাঙ্গনে কাজে ব্যস্ত ছিলেন এবং অদূরে অতি দুরন্ত নন্দের নন্দনকে দড়ি দিয়ে বেঁধে রেখে ছিলেন। গৃহ কাজে ব্যাঘাত ঘটাতে না পারে বলে, এইভাবে নিদারুণ অবস্থায় শিশুটিকে বেঁধে রাখতেন। এইরূপে একদিন যশোদা দেবী তাঁর এক ব্রত উৎযাপন করার জন্য ব্রাহ্মণ ভোজনের মনস্থ করলেন। ব্রাহ্মণ ভোজনের জন্য মহাত্মা কণ্ব মুনিকে ব্রাহ্মণরূপে আহ্বান জানিয়ে আমন্ত্রণ করলেন।কণ্বমুনিও তাঁর আমন্ত্রণে সাড়া দিয়ে যশোদাঙ্গনে পৌঁছলেন। যশোদা দেবীও মুনিকে যথাযোগ্য মর্যাদায় সম্মান প্রদর্শন করে শুদ্ধ-শাক্ত ও পরিপাটি করে ব্রাহ্মণভোজনের আয়োজন করলেন। কণ্ব মুনির কাছে ভোজনের জন্য যথাবিধি ভোজন দ্রব্যাদি সম্ভ্রবের সঙ্গে পরিবেশন করলেন।কণ্বমুনি ভোজনের আগে দেবতাদের উদ্দেশ্যে নিবেদনের নিমিত্ত পঞ্চগ্ৰাস মুদ্রায় নিবেদন করলেন। তৎক্ষণাৎ অতি দুরন্ত নন্দের নন্দন অদূরে দড়ি খুলে কণ্বমুনির নিবেদনের পাত্র হতে মিষ্টান্ন তুলে কিছু খেয়ে সেই পাত্রে রেখে চলে গেল।এই শিশুর উচ্ছিষ্ট হওয়ায় কণ্বমুনি কুপিত হলেন। মা যশোদাও ভয়ে এবং লজ্জিত হয়ে মুনির নিকট ক্ষমা প্রার্থনা করলেন।অনুনয় বিনয় করে তাঁকে ক্রুদ্ধ ও অভিশাপ দানে বিরত থাকতে অনুরোধ জানালেন।মুনিও ঘটনার আকস্মিকতায় অবাক হয়ে যশোদা দেবীর অনুনয়ে সাড়া দিলেন। মা যশোদা ও সমস্ত উচ্ছিষ্ট খাদ্যদ্রব্য পরিষ্কার করে, নতুন করে কণ্বমুনির ভোজন নিমিত্ত উৎকৃষ্ট খাদ্য দ্রব্যাদি তাঁর সামনে উপস্থাপন করলেন। ঠিক একই ভাবে কণ্বমুনি ভোজনের আগে খাদ্যাদি নিবেদন করলেন। যথারীতি শক্ত দড়িবন্ধনে আবদ্ধ নন্দের নন্দন বন্ধনমুক্ত হয়ে পঞ্চগ্ৰাসে নিবেদিত ভোজন পাত্রের খাদ্যদ্রব্য পূর্বের মতো নির্দিধায় উচ্ছিষ্ট করে দিলেন। এতে কণ্বমুনি খুব্ধ ও আশ্চর্যান্বিত হলেন এবং যশোদাকে তিরস্কার করলেন।পরে ঘটনার আকস্মিকতায় তিনি ধ্যানস্থ হয়ে সব অনুধাবন করলেন। এবারে আরো অধিক ভীত সন্ত্রস্ত হয়ে যশোদা দেবী কণ্বমুনির একেবারে পায়ে পড়ে শিশুর দোষ ত্রুটি মার্জনা পূর্বক সাশ্রুনয়নে করোজোড়ে তাঁর কৃপা প্রার্থনা করলেন। নিজের শিশুর আয়ত্ত না করতে পারার অপরাধে ও লজ্জায় কণ্বমুনির দিকে তাকিয়ে লক্ষ্য করলেন, ব্যাপারটা বুঝলেন কিছুটা শান্ত হয়েছেন মুনি, এইভেবে নিয়ে দ্রুততার সঙ্গে অন্য উৎকৃষ্ট ভোজন সামগ্ৰী অনুরোধ উপরোধ করে পুনরায় মুনির সম্মুখে সুচারুভাবে রাখলেন। কণ্বমুনি ও তাঁর অভ্যাস মতো ঈশ্বরের উদ্দেশ্যে নিবেদনের মাধ্যমে চক্ষু মুদ্রিত করে থাকলেন।এই সময় হঠাৎ করে সদ্য শান্তি প্রাপ্ত শিশু, ক্রন্দনভুলে অদূরে দড়ির বন্ধন খুলে নিমেষের মধ্যে নন্দের নন্দন ঈশ্বরের কাছে নিবেদনের আহ্বানে সাড়া দিয়ে সেই মুনির ভোজনপাত্র হতে নিয়ে মুখে দিয়ে সেই পাত্রে রাখল। কণ্বমুনি তৎক্ষণাৎ সেই শিশুর হাত ধরে ফেললেন।তপসিদ্ধ মহাত্মার বুঝতে বাকি রইল না যে,সে সামান্য শিশু নয় ,সে পরব্রহ্মকৃষ্ণ।পরম করুণাময় প্রেমের ঠাকুর।এ ঘটনার পরে কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে মা যশোদা ক্রন্দনরতা হয়ে ছুটে এসে অকাতরে মুনির পায়ে লুটিয়ে পড়লেন এবং শিশুর কৃতকর্মের জন্য আন্তরিক ভাবে ক্ষমা প্রার্থনা করলেন। মুনিও যশোদা দেবীকে ঘটনার প্রেক্ষিতে আশ্বস্ত করলেন এবং জগদ্বন্ধুর লীলার অনুক্ষণ প্রকাশ করলেন। এই স্মমরণীয় ঘটনার প্রেক্ষিতে একটি শ্লোক অবতারণা করলেন। শ্লোকটি হল
অর্থাৎ, মক্ষিকা (মৌমাছি), সন্ততি (সন্তান), দার (স্ত্রী), মার্জার (বিড়াল), ব্রহ্মবিন্দর (ওয়াটার ড্রপ লেট),বামা (স্ত্রীলোক), বালা (বালক বা বালিকা) প্রভৃতির মুখের উচ্ছিষ্ট কখনোও দূষিত হয় না।
এখানে কণ্বমুনি শিশু বা সন্তানের মুখচ্ছিষ্ট দূষিত নয়, অর্থাৎ সে শিশু সামান্য নয় স্বয়ং শ্রীকৃষ্ণের বাল্যরূপ।তাই তাঁর প্রসাদিত খাদ্য দ্রব্যাদি গ্ৰহণে কোনরূপ সংশয় নেই।
তখন থেকে কণ্বমুনির আপ্তবাক্য সমাজে পুরোপুরি ভাবে এর ব্যবহারের যথার্থতা প্রকাশ হতে লাগল। সেহেতু বই বা পুস্তক পাঠকালে মুখের জলকণায় বা পুস্তক কখনো দূষিত হয় না।
বর্তমানে কিন্তু এই ‘ব্রহ্মবিন্দর’ অর্থাৎ’ওয়াটার ড্রপ লেট’ কোভিড-১৯ বা করোনা ভাইরাস অতিমারী রোগের জীবাণু সংক্রমণের প্রকৃষ্ট মাধ্যম হিসেবে অভিহিত হয়েছে। এই করোনা ভাইরাস সারা বিশ্বের বিস্ময়! করোনা ভাইরাস এর আক্রমণে বিশ্ববাসীরা দিশেহারা,সন্ত্রস্ত ও বিভ্রান্ত।এই ভাইরাসের প্রকোপে বিশ্বের বিভিন্ন দেশের মানুষে সংক্রমিত হয়ে মৃত্যু মিছিল ত্বরান্বিত করেছে।তাই সম্প্রতি চিকিৎসাবিজ্ঞানীরা অর্থাৎ প্রখ্যাত ডাক্তারগণ, ভাইরাস-গবেষকগণ মনে করেন এই অতিমারী প্রকোপের লেলিহান শিখাকে প্রতিরোধ করতে গেলে মানুষের উচিত এই ‘ওয়াটার ড্রপ লেট’ বিস্তার রোধে প্রত্যেকের মুখে মুখোশ বা মাস্ক ব্যবহার অবশ্য অবশ্যই করণীয়। সেই কারণে এই অতিমারী প্রকোপের রোগ নিরাময়ে বিশেষজ্ঞদের পরামর্শ দিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা ‘সামাজিক দূরত্ব পালন করা, নিভৃত- বাস,শুদ্ধ ও প্রোটিন সমৃদ্ধ খাবার খাওয়া ইত্যাদি।
সনাতনী হিন্দু আচার চলে এসেছে তা ছিল অসম্ভব রকমের বিজ্ঞান ভিত্তিক অভ্যাস। এটা হয়তো তৎকালীন মানুষের অভ্যাস থেকে ঠেকে শেখার অভিজ্ঞতার ফল। সেই অভ্যাস চলে আসছে—নিভৃতবাস(হোমকোয়ারেন্টাইন), সামাজিক দূরত্ব (সোস্যাল ডিস্টেনসিঙ্) মেনে চলা,মাস্ক ব্যবহার করা প্রভৃতি গ্লোবালাইজেশনের মুখে সবাই সকলের আত্মীয়।কোভিড-১৯ বা করোনা ভাইরাস শিক্ষা দিয়েছে প্রাচীনকালের অভ্যাস বা রীতিনীতি বা শাস্ত্রীয়বিধান একেবারে উড়িয়ে দেওয়ার মতো ঘটনা নয়। সারা বিশ্বে মানুষের মৃত্যুমিছিলের সঙ্গে ভারতের মানুষের মৃত্যুমিছিলের সেরূপ ভাবে সামঞ্জস্য বিধান করলে হয়তো একেবারে মিলবে না, তবুও যেকোনো মৃত্যুই অনভিপ্রেত। মৃত্যু সতত দুঃখের। দুঃখের মধ্যেও আশার আলো কিছু মানুষ করোনা প্রকোপের করালগ্ৰাসকে বৃদ্ধাঙ্গুষ্ঠ দেখিয়ে করোনা জয়ী হয়েছেন। তাঁদেরকে অসংখ্য কুর্নিশ ও অভিনন্দন জানাই।
অভ্যাস তার প্রাচীনই হোক বা বর্তমানই হোক তা যদি মানুষের জন্য শুভ হয় তাকেই অনুসরণ করা উচিত। আমদের মধ্যে প্রেয় ও শ্রেয় র মধ্যে শ্রেয়কেই গ্ৰহণ করা উচিত নির্দিধায়। সুতরাং ব্রহ্মবিন্দর বা ‘ওয়াটার ড্রপ লেট’ অগ্নিতে না যাওয়া হোক, পুস্তকাদিতে পড়ুক, ভোগদ্রব্যাদিতে পড়ুক প্রভৃতি আচরণ ছিল হয়তো মুখের জীবাণুর সম্প্রসারণ না করা।তার দ্বারা শাস্ত্ররক্ষার মধ্য দিয়ে স্বাস্থ্যরক্ষার ব্যবস্থা ছিল বা রয়েছে। ধর্মশাস্ত্রকাররা যেমন এরূপ ব্যবস্থা করেছেন, তেমনি বর্তমানে চিকিৎসা- বিজ্ঞানের বিশেযজ্ঞগণ,গবেষকগণ একইভাবে মুখে মাস্ক পরা, সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখা,প্রোটিনযুক্ত সুষম খাদ্য গ্রহণ করে শরীরকে সুস্থ রাখার উপায়ের সুপরামর্শ দিয়েছেন। তার মাধ্যমে মানুষের এই কোভিড-১৯ বা করোনা ভাইরাস থেকে মুক্ত থাকার দিকদর্শন করিয়ে দিয়ে অতিমারী রোগ হতে বাঁচার জন্য প্রায়োগিক বিজ্ঞানসংক্রান্ত(টেকনিক্যাল) উপদেশ প্রদান করে যাচ্ছেন। সেগুলির দিকে লক্ষ্য রেখে আমাদের সমস্ত পালন করে যেতে হবে নিজেদের স্বার্থে বা সর্বজনীনকল্যাণে।
_____________
* এটি কনভারজেন্স-এর আয়োজনে ‘ভারতীয় ঐতিহ্য: সাহিত্য, সমাজ, সংস্কৃতি ও বিজ্ঞান’ বিষয়ক বক্তৃতামালার দ্বিতীয় বক্তৃতার সারসংক্ষেপ।
নরেন্দ্রনাথ দত্ত তথা বিবেকানন্দ গীত রবীন্দ্রসঙ্গীত – এই বিষয়ে কিছু বলতে গেলে ভূমিকা হিসাবে কয়েকটি তথ্য জেনে রাখা প্রয়োজন।
১৮৮০ সালের ডিসেম্বর মাসে ১৮ বৎসর বয়সের নরেন্দ্রনাথ দত্ত উঃ কলকাতার সিমলা অঞ্চলের তাঁর বন্ধু সুরেন্দ্রনাথ মিত্রের গৃহে শ্রীরামকৃষ্ণকে প্রথম দেখেন ও নিম্নলিখিত দুইটি গান শোনান।
১) প্রথম গানটি অযোধ্যানাথ পাকড়াশী রচিত “ মন চল নিজ নিকেতনে ”
২) দ্বিতীয় গানটি বেচারাম চট্টোপাধ্যায় রচিত “ যাবে কি হে দিন বিফলে চলিয়ে ”
এর পরে নরেন্দ্রনাথ তথা স্বামীজি শ্রীরামকৃষ্ণকে বিভিন্ন সময়ে মোট ৫০ টিরও বেশী গান শুনিয়েছেন। এবং তার মধ্যে বেশ কয়েকটি রবীন্দ্রনাথ রচিত সঙ্গীত।
উল্লেখ্য যে সঙ্গীতের মাধ্যমেই স্বনামধন্য এই দুইটি পুরুষের মধ্যে যোগাযোগ উনবিংশ শতকের বঙ্গীয় রেনেশাঁশের ইতিহাসে অবশ্যই এক বিশিষ্ট মাহেন্দ্রক্ষণ।
রবীন্দ্রনাথ তাঁর শ্রেষ্ঠ সৃষ্টি – সঙ্গীতের মাধ্যমে আমদের জীবনের প্রত্যেকটি অনুভূতিকে ছন্দে ও সুরে প্রকাশ করে জীবনকে যে প্রভাবিত ও আপ্লুত করেছেন সেই সঙ্গীত কি ভাগবতী তনু অবতারবিশিষ্ট শ্রীরামকৃষ্ণকে স্পর্শ করেছিল ? এইটিই এই লেখার আলোচ্য বিষয়।
উঃ কলিকাতার বিখ্যাত গায়ক বেণীওস্তাদের সুযোগ্য শিষ্য নরেন্দ্রনাথ দত্ত(বিবেকানন্দ) অত্যন্ত ভাল গায়ক ছিলেন ও বিভিন্ন ধরনের শাস্ত্রীয় ও অন্যান্য গান গাইতেন ও তিনিই একমাত্র ব্যক্তি যিনি শ্রীরামকৃষ্ণকে রবীন্দ্রসঙ্গীত শুনিয়েছিলেন। উনবিংশ শতকের দ্বিতীয়ার্ধের এক বিশেষ সময়ে গানের মাধ্যমে শ্রীরামকৃষ্ণ , স্বামী বিবেকানন্দ ও রবীন্দ্রনাথ – এই তিন লোকোত্তর ব্যক্তিত্বের আধ্যাত্মিক মেলবন্ধন হয়েছিল – এটি একটি সত্য। অনবদ্য সঙ্গীতগুলির রচয়িতা ও সুরকার রবীন্দ্রনাথ, গায়ক নরেন্দ্রনাথ তথা স্বামী বিবেকান্দ ও শ্রোতা স্বয়ং শ্রীরামকৃষ্ণ।
অল্প বয়স থেকেই ঈশ্বরানুরাগী নরেন্দ্রনাথ ব্রাহ্মধর্মের প্রতি আকৃষ্ট হয়ে কলিকাতার ব্রাহ্মসমাজে যাতায়াত শুরু করেন ও ঘটনাচক্রে রবীন্দ্রনাথের কাছেই তিনি প্রথম ব্রহ্মসঙ্গীত শোনেন ও শেখেন অর্থাৎ এই সঙ্গীতের মাধ্যমেই উভয়ের পরিচয়ের সূত্রপাত। “ কথামৃত ” বইটির তথ্য অনুযায়ী বিবেকানন্দ মোট ছয়দিন শ্রীরামকৃষ্ণকে রবীন্দ্রসঙ্গীত শুনিয়েছিলেন। ক্রমানুসারে বলা যায় –
১) ১৮৮৩ সালের ৭ই এপ্রিল বাগবাজারের বলরাম বসুর বাড়িতে জয়জয়ন্তী রাগাশ্রয়ী “ গগনের থালে রবিচন্দ্র দীপক জ্বলে ” এই গানটি নরেন্দ্রনাথ শ্রীরামকৃষ্ণকে প্রথম শোনান। গানটি গুরুনানক রচিত একটি বিখ্যাত ভজনের আক্ষরিক অনুবাদ।
২) এই গানটি নরেন্দ্রনাথ শ্রীরামকৃষ্ণকে পুনরায় শোনান ৯/৫/১৮৮৫ সালে।
৪) ১৪/৭/৮৫ ও ২৪/১০/৮৫ সালে নরেন্দ্রনাথ রবীন্দ্রনাথের দুইটি অসাধারন গান শোনান “ তোমারেই করিয়াছি জীবনের ধ্রুবতারা , এ সমুদ্রে আর কভু হব নাকো পথহারা ”। ওইদিনই বিবেকানন্দ আর একটি রবীন্দ্রসঙ্গীত শ্রীরামকৃষ্ণকে শুনিয়েছিলেন “ মহাসিংহাসনে বসি শুনিছ হে বিশ্বপতি ”।
৫) ১১/৩/৮৫ ও ১৮/৪/৮৬ তে বিবেকানন্দ শ্রীরামকৃষ্ণের সামনে ভাবে বিভোর হয়ে গাইলেন – “ দুঃখ দূর করিলে দরশন দিয়ে ” – রবীন্দ্রনাথের এই ব্রহ্মসঙ্গীতটি ।
৭) ৭/৫/৮৭ সালে শ্রীরামকৃষ্ণ বিবেকানন্দের কণ্ঠে শুনলেন “ আমরা যে শিশু অতি ”।
উল্লেখ্য তথ্য :
১) দার্শনিক, ভারততত্ত্ববিদ ও সুফী আচার্য্য ক্ষিতিমোহন সেন ( অমর্ত্য সেনের পিতামহ ) কাশীতে বিবেকানন্দের কণ্ঠে তিনটি রবীন্দ্রসঙ্গীত শোনেন ১৮৯০ ও ১৮৯২ সালে। “ একি এ সুন্দর শোভা ” , “ সখী আমারই দুয়ারে কেন আসিল ” এবং “ মরিল মরি আমায় বাঁশিতে ডেকেছে কে? ”
২) ১৮৯৯ সালে বিবেকানন্দের ২য় বার পাশ্চাত্য ভ্রমণের শেষে সিস্টার নিবেদিতার বোসপাড়ালেনের বাড়িতে চা পানের আসরে রবীন্দ্রনাথ তিনটি গান করেন , তার ভিতর একটি – “ বেলা গেল তোমার পথ চেয়ে ”।
জীবনে মাত্রাবোধ থাকা অত্যাবশ্যক। এর অভাবে মানুষের জীবনে নানাপ্রকার দুঃখ, বিপদ ও সমস্যা দেখা দিতে পারে। অথচ আমরা বিষয়টিকে কোন গুরুত্বই দিতে চাই না। জীবনের সর্বক্ষেত্রে যেমন, আহার-বিহার, নিদ্রা-জাগরণ, কর্ম-আলস্য, চলন-বলন এমন কি সাজসজ্জার ক্ষেত্রেও মাত্রাজ্ঞান অপরিহার্য।
মাত্রা হল একটি সীমারেখা, গণ্ডী, পরিমাপ। এটি যেন একটি লক্ষণরেখা, যার মধ্যে থাকলে মানুষ সুস্থ, নিরাপদ ও অনিন্দিত থাকে। রেখাটি লঙ্ঘন করলে আসে বিপদ, তিরস্কার, নিন্দা বা উপহাস। সামাজিক ক্ষেত্রে ও ব্যক্তিগত ক্ষেত্রে মাত্রা রক্ষা করতে জানলে নানা সমস্যা ও লাঞ্ছনা থেকে বাঁচা যায়।
আহারে মাত্রাহীনতা চরম বিপদ ডেকে আনে। প্রত্যেক মানুষের পাচনশক্তি পৃথক। তা উপেক্ষা করে লোভবশতঃ ভোজনের অভ্যাস অত্যন্ত বিপজ্জনক। ‘বিহার’ শব্দের অর্থ বিনোদন ধরা যেতে পারে। মাত্রাছাড়া আমোদপ্রমোদ ও বিলাস-ব্যসন শারীরিক অসুস্থতা ও ধনক্ষয় উভয়ের কারণ হয়। অতিরিক্ত নিদ্রা এবং বিশ্রামের অভাব – দুটিই শারীরিক সমস্যা ডেকে আনে। কর্ম ব্যতীত মানুষ বাঁচতে পারে না, কিন্তু অতিরিক্ত বা অপ্রয়োজনীয় কর্মে ব্যস্ত থাকা উচিত নয়। আবার কর্ম বিনাই জীবন চালানোর মনোভাবও ত্যাগ করা উচিত। জীবনযাত্রার পদ্ধতি, চলাফেরা এমন কি কথাবার্ত্তা বলার সময়ও একটা নিয়ন্ত্রণরেখা মেনে চলতে হয়। সেই নিয়ন্ত্রণরেখা সম্পর্কে শৈশব থেকেই সচেতন থাকতে হবে । যদি কোন কু-অভ্যাস হয়ে যায়, তা দৃঢ়তার সঙ্গে বর্জন করতে হবে। ব্যক্তিগত পরিসরে সদাচরণ ও কদাচরণ শেষপর্যন্ত সমাজের উপর প্রভাব ফেলে। নিজের ব্যবহার মানুষকে নিন্দা বা প্রশংসা এনে দেয়। মাত্রাজ্ঞান মানুষকে সুস্থতা, নিরাপত্তা ও প্রশংসার পথে চালিত করে।
* এটি কনভারজেন্স-এর আয়োজনে ‘ভারতীয় ঐতিহ্য: সাহিত্য, সমাজ, সংস্কৃতি ও বিজ্ঞান’ বিষয়ক বক্তৃতামালার তৃতীয় বক্তৃতার সারসংক্ষেপ।
বর্তমান ছত্তিশগড় প্রাচীন ভারতে ষোড়শ জনপদের মধ্যে কোশল দেশের দক্ষিণ অংশে ছিল। দক্ষিণ কোশল নামেই পরিচিত। ছত্তিশগড়ের রাজধানী রায়পুর। এই রায়পুরে আমার সেজোমামা থাকেন। তাঁর একশোতম জন্মদিন উপলক্ষে আমরা সদলবলে রায়পুর গেলাম। মামা নৃপেন চৌধুরী এক আশ্চর্য চরিত্র। যত দেখি তত বিস্মিত হই। একশো বছর বেঁচে আছে শুনলে আমরা অবাক হই। মনে ভাবনা আসে— বয়স, বার্ধক্য, অপারঙ্গমতা ইত্যাদি। কিন্তু সাদা ধুতি, পাঞ্জাবি পরিহিত সদ্য শতবর্ষ অতিক্রান্ত মানুষটিকে দেখলে মনে হয়, আমরা বোধহয় সেই ব্রিটিশ যুগেই দাঁড়িয়ে আছি, যেখানে বাঙালি তার দৃপ্ত চরিত্রের প্রকাশ ঘটাচ্ছে। প্রবাসে দীর্ঘ বছর থেকেও স্বাধীনতা-উত্তর ভারতের হাজার রকমের পরিবর্তনের মধ্যেও মামা সেই স্বাধীনতা সংগ্রামের যুগের মানুষ হয়ে বিস্ময় জাগাচ্ছেন। আধুনিক বিশ্বের সব খবর রাখেন কিন্তু দৈনন্দিন জীবনের রুটিনের কোন হেরফের নেই। অত্যন্ত স্বাবলম্বী, নিজস্ব ব্যক্তিগত সব কাজ নিজেই করেন। খাদ্যাভ্যাস, জীবনযাপনে ষোল আনা বাঙালি। সময়ানুবর্তী ও শৃঙ্খলিত জীবন। চার প্রজন্মের সুন্দর সহাবস্থান দেখে মুগ্ধ হতে হয়। মামার বাড়িই যেন সনাতন ভারতবর্ষ অথচ কোন অহেতুক সংস্কার নেই। পাশ্চাত্য জীবনের যাবতীয় সদ্গুণের হাওয়া বইছে। সকলেই কর্মঠ, আধুনিক প্রযুক্তিতে শিক্ষিত এবং অটুট পারিবারিক বন্ধনে আবদ্ধ। ধান ভানতে শিবের গাজন গেয়ে ফেললাম।
এক অভিনব জন্মদিন পালনের সাক্ষী হতে রায়পুর গেলাম। মামার একশত বছর উদযাপনের উৎসব (7th March 2023)। পরের দিন ছিল হোলি। সেও অভিনব। শতবর্ষের মামাকে নিয়ে চার প্রজন্মের হোলি খেলা অন্তরে চিরস্থায়ী এক সুখকর স্মৃতি হয়ে রইল। 9th March স্থির করা হল, আমরা রায়পুর থেকে ৮৫ কিলোমিটার দূরে সিরপুর গ্রামে যাব।
অত জায়গা থাকতে সিরপুর কেন? প্রত্নতত্ত্ববিদ ও ইতিহাসবিদদের কাছে এ এক তীর্থস্থান। বৈদিক সাহিত্যে ছত্তিশগড়ের কোন উল্লেখ নেই। রামায়ণে কোসল রাজ্যের উল্লেখ আছে। শ্রীরামচন্দ্রের মা কৌশল্যা ছত্তিশগড়ের (কোসল) রাজা ভানুমন্তের কন্যা ছিলেন। যেহেতু ভানুমন্তের কোন পুত্র ছিল না কোসল রাজ্য ও কৌশল্যার অধিপতি রাজা ভানুমন্ত অযোধ্যার রাজা দশরথের অধীনে ছিল। শোনা যায় বনবাসকালের কিছুদিন রামচন্দ্র এই ছত্তিশগড়ের অরণ্যে অতিবাহিত করেন। বাল্মীকির আশ্রমও এই ছত্তিশগড়েই ছিল। নির্বাসিতা সীতা বাল্মীকির আশ্রমেই ছিলেন এবং এইখানেই লব ও কুশের জন্ম হয়। শ্রীরামচন্দ্রের পুত্র কুশ এই দক্ষিণ কোসলের রাজাও ছিলেন।
মহাভারতে ছত্তিশগড়ের উল্লেখ প্রাককোসল নামেই ছিল। অর্জুনের পুত্র বভ্রূবাহনের রাজত্ব ছিল প্রাককোসলে এবং তার রাজধানী ছিল সিরপুরে। ষষ্ঠ শতাব্দীতে ষোলো মহাজনপদের একটি জনপদ কোসল অর্থাৎ ছত্তিশগড় ছিল। ছত্তিশগড়ে ভগবান বুদ্ধের আগমনের প্রমাণ পাওয়া যায়।
প্রায় পঞ্চম শতকে দক্ষিণ কোসলে (ছত্তিশগড়ে) শরভপুরী বংশ রাজত্ব করে। ছত্তিশগড়ে শরভপুরী বংশের সব রাজাই গুপ্তযুগ এবং গুপ্তোত্তর যুগের ছিলেন।
শরভপুরী বংশের পর এই অঞ্চলে পান্ডু বংশীয় রাজ্য স্থাপিত হয়। সোম বংশ নামে এই বংশ পরিচিত। রাজা উদয়নের দ্বারা পান্ডু বংশের স্থাপনা। উদয়নের পুত্র ইন্দ্রবল পরাক্রমশালী রাজা ছিলেন। তাঁর চার পুত্রের মধ্যে তিন পুত্রের নাম জানা যায়: নন্ন, ঈশানদেব আর ভবদেব রণকেশী। নন্নের পুত্র তীবরদেব রাজ্যের বিস্তার ঘটিয়েছিলেন। তীবরদেবের উত্তরাধিকারী ছিলেন তাঁর ভাই চন্দ্রগুপ্ত। চন্দ্রগুপ্তের পুত্র হর্ষগুপ্তের বিয়ে হয় মগধের মৌরবরি রাজা সূর্যবর্মার কন্যা বাসটার সঙ্গে। হর্ষগুপ্তের ছেলে মহাশিবগুপ্ত দীর্ঘদিন রাজত্ব করেন। তিনি মহাশিবগুপ্ত বালার্জুন নামে প্রসিদ্ধ ছিলেন। বালার্জুনের শাসনকালে ওনার মা রানী বাসটা স্বামী হর্ষগুপ্তের স্মৃতিরক্ষার্থে বিষ্ণু মন্দির নির্মাণ করান। সিরপুরে স্থিত এই বিষ্ণু মন্দির লক্ষ্মণ মন্দির নামে খ্যাত। মহাশিবগুপ্ত বালার্জুন শৈব ছিলেন কিন্তু ভিন্ন ধর্মের প্রতি উদার মনোভাব পোষণ করতেন। ওনার রাজত্বকালেই চৈনিক পরিব্রাজক হিউয়েনসাঙ এসেছিলেন। তিনি লিখে গেছেন রাজা বালার্জুনের বৌদ্ধ ধর্মের প্রতি আস্থা। তিনি সিরপুরের বৌদ্ধ বিহারের বর্ণনা করে লিখেছেন এই অঞ্চলে ১০০ সংঘারাম আছে, যেখানে ১০ হাজার মহাযানী বৌদ্ধভিক্ষু বাস করে।
মনে করা হয় ৩৬টি গড় বা কেল্লার জন্য এই অঞ্চল ছত্তিশগড় নামে খ্যাত। আবার কেউ কেউ বলেন ছত্তিশগড়ে চেদি বংশের শাসন ছিল। চেদি রাজার নামানুসারে চেদিগড় বলা হত। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে সেটি চেদিসগড়ে রূপান্তরিত হয় এবং অপভ্রংশ হয়ে নাম হয় ছত্তিশগড়।
আমার দাদা সঞ্জয় ভট্টাচার্যের তত্ত্বাবধানে ছত্তিশগড়ের মহাসমুন্দ জেলার সিরপুরে আমরা এসে পৌঁছলাম বেলা বারোটা নাগাদ। সিরপুরে ঢোকার রাস্তা বড় সুন্দর। দুপাশে বড় বড় গাছ। বসন্তের আগমন বার্তা চারিদিকে। পলাশফুলের সমারোহে চারদিক আগুনরঙা। নির্জন মসৃন রাস্তায় গাড়ি চলেছে। সিরপুরের কাছে আসতেই বোঝা গেল এককালে এটি একটি সমৃদ্ধ অঞ্চল ছিল। রাস্তার দুপাশে লাল ইটের কাঠামো। মন্দিরের অবয়ব, ভাঙ্গা স্তম্ভ। হঠাৎ দেখি আমাদের ড্রাইভার বেশ উত্তেজিত। একটা জায়গায় গাড়ি থামিয়ে সে দৌড়ে গেল। যেখানে গাড়ি থামালো, তার পাশেই ASI এর তত্ত্বাবধানে খনন করে পাওয়া স্তূপ। ‘সুরং টিলা’র ভগ্নাবশেষ। বাইরে থেকেই সাদা রঙের পাথরের মন্দিরের কাঠামো বড় সুন্দর লাগছিল। ড্রাইভার শ্রবণকুমার গাড়ি থেকে নেমে একটা বন্ধ বাড়িতে জোরে জোরে ধাক্কা দিল। সাড়াশব্দ না পেয়ে গাড়িতে ফিরে এল। জিজ্ঞেস করার আগেই বলল, ‘ইয়ে মেরা সসুরাল’। শাশুড়ি একাই থাকেন, চোখে দেখে না, কানে শোনে না। বাড়িতে শাশুড়ি থাকলে দুপুরের খাওয়াটা এখানেই খেতে পারত।
দাদাদের গাড়ি এগিয়ে গিয়েছিল। প্রথমে আমরা গেলাম গন্ধেশ্বর মন্দির। গাড়ি থেকে নামতেই টের পাওয়া গেল সূর্যদেবের গরিমা। মন্দিরটি মহানদীর ধারে। বিশাল মহানদী এখন জলশূন্য। ছেলে, বুড়ো, মহিলারা পায়ে হেঁটে চলেছে নদীর পরপারে। সাইকেল, স্কুটার নিয়েও চলেছে। কী শান্ত জায়গা! নদী অনেক নীচে। বিশাল চাতাল। বড় বড় গাছের ছাওয়া। মন স্নিগ্ধ হয়ে গেল। মহানদীর তীরে এই মন্দির অত্যন্ত মনোমুগ্ধকর, শৈল্পিক ও ইতিহাস সমৃদ্ধ। এই মন্দিরের ভিতর অত্যন্ত আকর্ষণীয় পুরাতত্ত্বের ধ্বংসাবশেষ। দুর্লভ মূর্তির অনবদ্য সংগ্রহ রয়েছে। বিহার ও প্রাচীন মন্দিরের ধ্বংসাবশেষ পর্যটকদের আকর্ষণ না করে ছাড়ে না। ভূমি স্পর্শ করা বুদ্ধের মূর্তি, তার পাশেই শিবলিঙ্গ, নটরাজ, গরুড়, নারায়ণ, মহিষাসুরমর্দিনীর মূর্তি দুর্লভ ও আকর্ষণীয়। রাবণের এক দুর্লভ মুখের মূর্তি দেখলাম। মন্দিরে ঢোকার মুখে শিবলীলার বহু চিত্র খোদিত রয়েছে। মন্দির চত্বরে বট গাছের ছায়ার নীচে বসে মহানদীর পারিপার্শ্বিক দৃশ্য উপভোগ করলাম।
লাঞ্চ খাওয়ার ব্যবস্থা করে আমরা জঙ্গলে ঝরনা দেখার বাসনায় রওয়ানা হলাম। গাইড তেজপাল লাঞ্চের পরে এসে আমাদের সঙ্গে যোগ দেবেন। ইতিহাস বিনা প্রত্নতত্ত্বের ধ্বংসস্তূপ শুধুই পাথর আর মাটি। গাইডের বাক্যনৈপুণ্যে মৃত ইতিহাস জেগে ওঠে, ইট, কাঠ, পাথর প্রাণ পায়।
জঙ্গলের পথে বহুদূর যাওয়া হল কিন্তু যৌবনাবতী, বেগবতী ঝরনা কিংবা নিদেন পক্ষে ‘তিরি তিরি ঝোরা’ কোথায়? বন জঙ্গলের মধ্যে রাস্তা অপূর্ব সুন্দর কিন্তু গাড়ি যাওয়ার পথ কই? দিশাহীন হয়ে দুটো গাড়িই থামল।কয়েকটি বাইক গেল সামনের পথে। তাদের জিজ্ঞেস করে জানলাম তাদের গন্তব্য পথও ঝরনা। বাইক তবু চলে যাবে, গাড়ি যাওয়ার পথ নেই। খানিক পরে বাইকবাহিনী হতাশ মুখে ফিরে এল। গুগুল বাবাজি বলছে খুব নিকটেই ঝরনা। এদিকে বেলা ক্রমশঃ এগোচ্ছে। ড্রাইভার যুগল জানালো অজানার পথে গিয়ে প্রকৃত দ্রষ্টব্য সিরপুরে যে জন্য আসা তা দেখার সময় হবে না। খিদেও পেয়েছে সকলের। অতএব গাড়ি ঘুরিয়ে সোজা সরকারি রিসর্টে যেখানে দ্বিপ্রাহরিক খাবারের বন্দোবস্ত হয়েছে।
খাওয়া দাওয়া ভালমতো সাঙ্গ হবার পর দেখা গেল গাইডদাদা নির্দিষ্ট সময়ে, নির্দিষ্ট স্থানে এসে অপেক্ষা করছেন।
প্রথমে গেলাম বুদ্ধ বিহারে। সিরপুরকে শ্রীপুরও বলা হত। নামটি যথাযোগ্য ছিল। প্রাচুর্যে ভরপুর ছিল। তীবরদেব ও শিবগুপ্ত বালার্জুনের সময় (ষষ্ঠ থেকে অষ্টম শতক) স্থানটি অত্যন্ত সমৃদ্ধ ছিল। মন্দির ও বিহার ছিল সমমর্যাদায়। সেই বুদ্ধ বিহারে ঢুকে তার ভগ্নাবশেষ, মূর্তি ও স্থাপত্য দেখে মুগ্ধ হতে হয়। সিরপুরে ১০০ বিহারের মধ্যে কয়েকটি অবশিষ্ট আছে। এখানে ইটের বানানো দেওয়াল ও অন্য অলংকরণ পাথরে খোদিত। এখানে আনন্দপ্রভ নামে বৌদ্ধ ভিক্ষু সম্বলিত শিলালিপি পাওয়া গিয়েছে ও ভগবান বুদ্ধেরও অনেক মূর্তি পাওয়া গিয়েছে।
১৮৭১ খ্রীষ্টাব্দে ব্রিটিশ পুরাতত্ত্ববিদরা সিরপুরে মাটির নীচে পুরাকালীন শহরের অস্তিত্বের কথা জানতে পারেন। কানিংহাম ১৮৪টি ‘সাইট’ বা স্থানের কথা বলেন। তার মধ্যে আজ পর্যন্ত ৩৯টি স্থান খনন করা হয়েছে। খননের ফলে দেখা গেল মহানদীর তীরে ইটের বানানো দেওয়াল, পাথরে অলংকরণ করা মন্দির, বিহার আবিষ্কৃত হয়। শিব মন্দিরও পাওয়া যায়। সবই সপ্তম শতকের সময়ের। তোরণে যে নকশা পাওয়া যায়, ভারতবর্ষের অন্যত্র কোথাও নেই। (এটা অবশ্য গাইডদাদা মারফত তথ্য) তা শুধু এই সিরপুরেই আছে। তোরণে জাতকের গল্প উৎকীর্ণ। বাঁদর আর কুমীরের গল্প, নকশায় আম গাছ, আম্রপল্লব, খেজুর গাছ, গরুড়, গজলক্ষ্মী, পায়ে পায়েল ও কোমরে কোমরবন্ধ পরিহিত নারী মূর্তি, দ্বারে দ্বারপাল, নারীপুরুষের যুগল মূর্তি, সদ্যোজাত বাছুরের গা চেটে দেওয়া মা গাই এর মূর্তি খোদিত তোরণগুলিতে। গাইডদাদা মূর্তি গুলি দেখিয়ে এত সুন্দর ব্যাখ্যা করছিলেন, মনে হচ্ছিল ঐ সময়েই আমরা পৌঁছে গিয়েছি। উন্মুক্ত প্রান্তরে চারিদিকে পাথরের স্তম্ভ, মূর্তি সব কিছু দেখে বিহ্বল হয়ে পড়ার অবস্থা। কিন্তু বিহ্বল হলে তো চলবে না আরও অনেক কিছু দেখবার আছে।
পরের গন্তব্য লক্ষ্মণ মন্দির। এটি আসলে বিষ্ণু মন্দির। ইটের দ্বারা নির্মিত এই মন্দির ভারতীয় স্থাপত্যকলার এক অনন্য উদাহরণ। মন্দিরের বাইরের দেওয়াল আর চূড়াতে উত্তর ভারতের মন্দিরের লুপ্ত শৈলী, উড়িষ্যা আর অন্ধ্রের কলাশৈলীর মিলিত রূপ দেখা যায়। মন্দিরের গর্ভগৃহের প্রবেশদ্বারের ওপর বিষ্ণুর শায়িত মূর্তি ও বিষ্ণুর দশাবতার রূপ উৎকীর্ণ । উৎকীর্ণ কৃষ্ণলীলাও বিশেষ আকর্ষণীয়। দ্বারের ডানদিকের স্তম্ভের একদম নীচে মিথুন মূর্তি। মন্দির শিখরের স্থাপত্য বৌদ্ধ চৈত্যের আকৃতিতে বানানো। হিউয়েন সাঙের লেখায় এই মন্দিরের উল্লেখ আছে। কানিংহাম সাহেব ১৮৭২ সালে মন্দিরটি আবিষ্কার করেন। বিষ্ণু মন্দিরটি লক্ষ্মণ মন্দির নামে বিখ্যাত হয় লক্ষ্মণের ছোট কালো মূর্তির জন্য। এই মন্দিরটিই রানী বসটা স্বামী মহাশিবগুপ্ত বালার্জুনের স্মৃতি রক্ষার্থে নির্মাণ করিয়েছিলেন।
লক্ষ্মণ মন্দিরের পাশেই ভারত সরকারের মিউজিয়াম। সিরপুরে খননের ফলে যে সব মূর্তি, স্থাপত্য পুনরুদ্ধার করা হয়েছে তাদের সযত্নে এই মিউজিয়ামে রাখা হয়েছে। স্থাপত্য শৈলী দেখলে মুগ্ধ হতে হয়। মহিষাসুরমর্দিনীর অপূর্ব সুন্দর এক মূর্তি, একদম অন্যরকম।
গাইডদাদা এরপর আমাদের নিয়ে গেল প্রাচীন বাজার অঞ্চলে। বিশাল অংশ খনন করে পাওয়া গেছে হরপ্পা, মহেঞ্জোদরো, ধোলাভিরার মতো চতুষ্কোণ করা ক্ষেত্র। এখানে নাকি বড় ব্যবসাকেন্দ্র ছিল। সুরাট, কটক-এর সঙ্গে ব্যবসায়িক আদান প্রদান হত। জায়গাটা খুবই সুন্দর। চারিদিকে আয়তাকারে কাটা ইটের প্রাচীর। দূরে দূরে বড় বড় গাছ। গাছে গাছে আগুনরাঙা ফুল। একটা গাছে প্রায় সাত আটটা হনুমান ফুল খাচ্ছে । জায়গাটায় দাঁড়িয়ে উপলব্ধি করছিলাম প্রাচীন ভারতের রূপকে। অতীতের হারিয়ে যাওয়া এক সমৃদ্ধ নগরীকে আজ মাটির তলা থেকে উদ্ধার করে আনার চেষ্টা চলছে। পুরাতন নগরীর উপর আধুনিক ভারতের গ্রাম্য জীবন চলমান। মানুষজনকে সরিয়ে সেই অতীতকে ফিরিয়ে আনা চাট্টিখানি কথা নয়। বর্তমান মানুষজনই বা যাবে কোথায়? আর অতীত নগরীকে পুরোপুরি উদ্ধার করতেও সরকারের কোষাগারের উপর প্রবল চাপ পড়বে। তবু মানুষ চায় অতীতকে জানতে, কেমন ছিল আমাদের দূর অতীতের পূর্বপুরুষের জীবনধারা?
এরপরে আরও চমক ! কী অসাধারণ এই সুরংটিলা। সাদা পাথরে বানানো পাঁচটি মন্দির, অপূর্ব তার রূপ। বিকেলও হয়ে আসছে। বিদায়ী সূর্যের রক্তিম আভা সাদা পাথরের পাঁচটি মন্দিরের উপর মায়াময় রূপ ফুটিয়ে তুলেছে। ২০০৫-২০০৬ সালে সুরংটিলা মাটির গভীর থেকে উদ্ধার করে আনা হয়। প্রধান মন্দিরটি ৩৭ টি চুনাপাথরের খাড়া সিঁড়ি পেরিয়ে উচ্চতলে অবস্থিত। বলা হয় যে, দ্বাদশ শতকে বিধ্বংসী ভূমিকম্প হয় এখানে। তার প্রত্যক্ষ প্রমাণ দেখলাম। সিঁড়ি চড়তে গিয়ে দেখা গেল, ভয়ানক ভাবে ট্যারাবাঁকা হয়ে আছে। সিঁড়ি চড়তে এবং নামতে রীতিমতো অভিযান করতে হল। উপরে উঠে মুগ্ধ হলাম এই কথাটাও খুবই কম বলা হল। বাক্যহারা হয়ে গেলাম। মন্দিরটি বানানো হয়েছিল সপ্তম শতকে মহাশিবগুপ্ত বালার্জুনের দাক্ষিণ্যে। মন্দির স্থাপত্যের এক শৈলী হল পঞ্চায়তন। মূল মন্দির থাকে মাঝখানে আর তাকে ঘিরে চার কোণে সহায়ক চারটি মন্দির। এই সুরংটিলার মধ্যিখানে মূল মন্দির এবং উত্তরপূর্ব, দক্ষিণপূর্ব, দক্ষিণ পশ্চিম ও উত্তর পশ্চিমে বাকি চারটি মন্দির। পাঁচটি মন্দিরের চারটি মন্দির শিবের উদ্দেশ্যে স্থাপিত। চারটি শিবলিঙ্গ চার রঙের — লাল, হলুদ, সাদা এবং কালো। বাকিটি গণেশ মূর্তির (হাতির মাথার গণেশ ঠাকুর) উদ্দেশে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। এখানে যে পাঁচটি মন্দির দেখলাম তার চূড়াগুলোতে বৌদ্ধ চৈত্যের স্থাপত্য। চৈত্যের মধ্যে মূর্তি আর তার উপর পশ্চিমের অস্ত যাওয়া সূর্যের রক্তিম আভা এসে পড়ছে। এক অদ্ভুত অনুভূতিতে মন আচ্ছন্ন হয়ে গেল। উপর থেকে চারিপাশ দেখতে খুব ভাল লাগছিল, নামতেই ইচ্ছে করছিল না। নীচের দিকে তাকাতে মাথাটা ঝিঝিম করে উঠল। এই বাঁকাচোরা খাড়া সিঁড়ি নামি কীভাবে? এ যে অভিযানের চূড়ান্ত পর্যায়। গাইডদাদার সহযোগিতায় নীচে নেমে এলাম।
নীচে মন্দিরের ভগ্নাবশেষ এক বিশাল চত্বর জুড়ে। এখানে ৩২টি ধ্বংসপ্রাপ্ত স্তম্ভ পাওয়া গেছে। এই চত্বরেই আবার তিনটি তান্ত্রিক মন্দিরের ধ্বংসাবশেষ পাওয়া গেছে: ব্রহ্মা, বিষ্ণু ও শিবের প্রতি উদ্দিষ্ট। আরও দুটো স্তম্ভের ধ্বংসাবশেষ দেখিয়ে গাইডদাদা জানালেন যে একটিতে পুরোহিতের বাসস্থান ও অন্যটি সন্ন্যাসীর।
লক্ষ্মণ মন্দিরের কাছেই রাম মন্দির। রাম মন্দির পাথরে নির্মিত উঁচু টিলার উপর অবস্থিত। এই মন্দিরটিও ২০০৩-২০০৪ সালে খননের ফলে আবিষ্কৃত হয়েছে। এটিও সপ্তম শতকে নির্মিত। এখানে যুগল মন্দিরের পরিকল্পনা ছিল। দুটি মন্দিরের একটিই ভগ্ন অবস্থায় পাওয়া গেছে। দ্বিতীয় মন্দিরের শুধু পরিকল্পিত রূপটিই পাওয়া গেছে। ভগ্নাবশিষ্ট মন্দিরটির চাতাল ও মন্দির আছে কিন্তু মন্দির এবং গর্ভগৃহের ছাদ সম্পূর্ণ ভাবে নষ্ট। স্তম্ভ গুলো ধ্বংসপ্রাপ্ত। কিছু কিছু ভগ্ন মূর্তিও পাওয়া যায়। খনন করে এখানে মাটির নীচে আরও তিনটে ঘর পাওয়া যায়। মনে করা হয় একটি পুরোহিতের ঘর, অন্যটি শস্যাগার। পুবমুখী যে অংশটি পাওয়া যায় সেটি শাঁখের চুড়ি বানানোর ঘর বলে মনে করা হয়। সেই ঘরে প্রচুর পরিমাণে শাঁখের চুড়ি, শাঁখ ও অর্ধসমাপ্ত চুড়ি পাওয়া গেছে। এই রাম মন্দিরের বৈশিষ্ট্য হল এটি দক্ষিণ কোশলে মন্দিরের পরম্পরার একটি প্রাচীন উদাহরণ। পরম্পরাটি হল তারার আকারে মন্দির নির্মাণ।
মনের মধ্যে অতীতের সিরপুরকে উত্তমরূপে উপলব্ধি করে রায়পুরের উদ্দেশ্যে রওয়ানা হলাম।
আমাদের ড্রাইভার শ্রবণকুমার হঠাৎ গাড়ি থামিয়ে দৌড়ে গেল সকালের সেই বাড়িটার দিকে। তারপর দেখি এক মধ্যবয়সী ভদ্রমহিলার হাত থেকে ব্যাগ নিয়ে বন্ধ দরজার সামনে দাঁড়াল। ভদ্রমহিলা দরজার তালা খুললেন। শ্রবণকুমার হাসিমুখে জানাল যে ইনিই শাশুড়ি। শাশুড়ি আর জামাই এর বয়সের বিশেষ তফাৎ চোখে পড়ল না। শ্বশ্রূমাতা আবার চায়ের নিমন্ত্রণ করলেন। দর্শনেই আমরা মুগ্ধ। আমন্ত্রণ রক্ষা করা আর সম্ভব হল না।
সিরপুরকে পিছনে ফেলে বর্তমান জগতের দিকে ধাবমান হলাম। একদিন হয়তো এই বর্তমান যুগটিও কালের গহ্বরে বিলীন হবে। বহু বহু বছর পরে হয়তো আবার আবিষ্কৃত হবে বর্তমান সময়ের প্রমাণ।
তথ্য সূত্র:
(১) ‘আদিবাসীগঢ় ছত্তীশগঢ়’। লেখক, সুশীল গৌতম। প্রকাশন বিভাগ, সূচনা ঔর প্রসারণ মন্ত্রালয়, ভারত সরকার
(২) ছত্তিশগড় ট্যুরিজমের লিফলেট
(৩) গাইড মুখ-নিঃসৃত বাণী
(৪) গুগল
* কর্মী, ভারত সঞ্চার নিগম লিমিটেড (বি এস এন এল) এবং কনভারজেন্স-এর জার্মান লেভেল-১ কোর্সের শিক্ষিকা।
On a recent visit to Shillong, during the very scenic drive from the quaint Shillong airport to a resort near the Umiam lake, not surprisingly perhaps, I had noticed several idyllic houses having roosters and chickens running around in their front yards.
I was however surprised when on another ride towards the City of Shillong, I noticed a massive gate sort of a structure with a rooster painted on it. Almost at the same time, I saw a car passing by (that was being driven by a woman) and which sported a red flag in front of its bonnet. The flag had the silhouette of a rooster in yellow. Surprised, I asked the chauffeur who was driving us, about what it was about.
Albert, who himself was a Christian from the Garo tribe, said it was Jaintia custom to worship rooster.
I later found out that the big gate-like structure was the entrance to U Lum Sohpetbneng, popularly known as “umbilical heavenly peak” or “navel of the earth” (sohpet in Khasi means navel, bneng means heaven and lum means hill).
It was near the Umiam Lake (commonly referred to as Barapani), atop the 1,344-metre high peak, 17 km north of Shillong, the capital of Meghalaya, and was on our left when we were Shillong bound from Umiam. According to a tribal legend, the sub tribes of Khasi race, Khynriam, Pnar, Bhoi, War, Maram, Lyngngam and the now-extinct Diko of Meghalaya, collectively known as Ki Hynniewtrep (hynneiw means seven), which literally means ‘Seven Huts’ referring to the seven families, were the first humans on earth. According to the Khasi mythology, God, had originally distributed the human race into sixteen heavenly families, seven huts on earth and nine huts in heaven (see the write-up on the board in the picture below), which are connected to the creator by a golden ladder on U Sohpetbneng (literally meaning Mount of the Heavenly Umbilical Cord). “During the Golden Age the sixteen families physically commuted between heaven and earth along the golden oak vine on the summit of U Lum Sohpetbneng. When sin crept and covered the earth the golden bridge was broken. Nine families remain in the celestial abode and seven settled on earth and multiplied.”
People could use the heavenly ladder resting on the sacred Lum Sohpetbneng Peak to travel to heaven whenever they pleased until one day they were tricked into cutting a divine tree which was situated at Lum Diengiei Peak (also in present-day East Khasi Hills district), a grave error which prevented them from going to heavens thereafter. (This myth can, in fact, be perceived to be how nature and trees, in particular, are the manifestation of the divine on earth, so that destruction of it, naturally means severing our ties with the divine.)
Hence the structure is the entrance to the Lumsohpetbneng or the Golden ladder. (It is also believed that the seven tribes who were left on earth after the ladder broke are like the seven continents and the nine tribes in heaven are like the nine planets.) The golden ladder is no longer there but there are imprints that can be seen today in the rocks, in the vicinity of the summit.
The annual indigenous tribal pilgrimage to the Sacred U Lum Sohpetbneng is held on the first Sunday of February.
Now the symbol used by the believers is the ‘Rooster’ – harbinger of ‘Light and Enlightenment’. The rooster was a universal solar symbol across Eurasia, the Near and Middle East and Europe as a bird that heralded the dawn with its crowing and that would dispel evil spirits as the light of day dispelled darkness. Veneration of the rooster in East Asia is particularly widespread, but is most closely associated with Japan and China where the rooster is entrenched as the tenth of the twelve animal symbols in the Chinese zodiac.
In Japan, its crowing is believed to lure Amaterasu (the principal deity of the Japanese Shinto religion, the sun goddess and ancestor of Jimmu, founder of the imperial dynasty), Goddess of the Sun, out of the cave where she had been hiding. The Japanese (like other Far Eastern people) attribute the virtue of courage to the rooster. The white cockerel is an auspicious symbol in Japanese Shinto (a Japanese religion dating from the early 8th century and incorporating the worship of ancestors and nature spirits and a belief in sacred power of both animate and inanimate things. It was the state religion of Japan until 1945). Chickens are thought of as messengers of the gods at the Isonokami Shrine (one of the oldest Shinto shrines of Japan, frequented by many members of the Imperial Family, it played a pivotal role in Japan’s early history. The shrine is at the end of the oldest road in Japan).
Animism, historically, characterises the belief system of many indigenous peoples, in contrast to the relatively more recent development of organized religions. Animism (from Latin: anima meaning ‘breath, spirit, life’) is the belief that objects, places, and creatures all possess a distinct spiritual essence. Accordingly, “[A]lthough each culture has its own mythologies and rituals, animism is said to describe the most common, foundational thread of indigenous peoples’ “spiritual” or “supernatural” perspectives.” This was my first visit to the North-east. But as a student, I had studied about these parts in Geography at the school level decades back and the only fact that distinctly stuck in mind seems to be the matrilineal system practised amongst the tribes there. Albert said, that was still in vogue and that he has left his parents’ home in Assam to come stay with his wife and her family in Shillong. So it seems that the tribes have largely maintained their matriarchal culture. Jaintias are mostly Hindus while Garos and Khasis were mainly Christians, Albert said.
I asked Albert whether he’s been inside the Lum Sohpetbneng, and he said he was a Roman Catholic of the Garo tribe and he hasn’t been inside. But with the Umiam lake, almost still shedding tears with sombre serenity, the almost living clouds whispering legends, and even the roadside flowers springing colours and almost writing poems, the golden ladder rising high up to the clouds, ready to help us lesser mortals to heaven, almost seems true.