প্রাত:স্মরণীয় যাঁরা

*সোমা বসু

১) ভারতবর্ষের প্রাচীন ভাষা ও সাহিত্যবিষয়ক গবেষণা, পঠন ও পাঠনে নিয়োজিতপ্রাণ কিছু জার্মান ভারততত্ত্ববিদের সংক্ষিপ্ত জীবনী এবং ভারতীয় সাংস্কৃতিক জীবনে তাঁদের অবদান নিয়ে  সূত্রপাত এই রচনার-

         আধুনিক সময়ে প্রধানত: বাণিজ্যিক কারণে বেশী সংখ্যায় ইওরোপীয়দের ভারতবর্ষের মাটিতে পদার্পণের সঙ্গে সঙ্গেই এদেশ এবং এদেশের সংস্কৃতি সম্পর্কে তাঁদের উৎসাহ প্রবল আকারে দেখা দেয় । Switzerland, Austria এবং Germany র ভারতবর্ষের মাটিতে উপনিবেশ স্থাপনের কোন আকাঙ্ক্ষা না থাকলেও এইসব দেশের পণ্ডিতরা ভারততত্ত্বে প্রচুর অবদান রেখেছেন । ইওরোপে এই সব পণ্ডিতদের বিশেষ খ্যাতি ছিলো না । উনবিংশ শতকে Sir William Jones কৃত অভিজ্ঞানশকুন্তলা অনুবাদের জার্মান তর্জমা প্রকাশিত হওয়ার পর ভারতীয় চিন্তাধারা ও সাহিত্যের প্রতি তাঁদের গভীর মুগ্ধতা দেখা দেয়। August Wilhelm von Schlegel এবং তাঁর ভ্রাতা Friedrich সংস্কৃত ভাষায় পারদর্শিতা লাভ করেন, ১৮১৮ সালে Bonn বিশ্ববিদ্যালয়ের ভারততত্ত্বের Chair Professor পদ স্থাপিত হলে প্রথম সংস্কৃত অধ্যাপকের পদে বৃত হ’ন August Wilhelm von Schlegel ৫১ বছর বয়সে। তিনি নিজের স্থাপিত ছাপাখানায় ল্যাটিন অনুবাদ সহ দেবনাগরী হরফে শ্রীমদ্ভগবদ্গীতা ছাপান। প্রুসিয়ান মন্ত্রী, বিশ্ববিদ্যালয়-গবেষক, ভাষাবিজ্ঞানী এবং দার্শনিক Wilhelm von Humboldt শ্রীমদ্ভগবদ্গীতা পাঠ করে গভীরভাবে প্রভাবিত হ’ন। ২ বছর পরে ১৮২০ সালে তাঁরই উদ্যোগে বার্লিন এ ভারততত্ত্বের দ্বিতীয় অধ্যাপকপদ সৃষ্ট হয় যেখানে Franz Bopp ঐ বিষয়ে প্রথম অধ্যাপক পদ অলঙ্কৃত করেন । মাত্র ২৫ বছর বয়সে তিনি সংস্কৃতের সঙ্গে ইন্দো-ইওরোপীয় ভাষাগুলির তুলনামূলক সম্পর্ক বিষয়ক গবেষণাপত্র রচনা করেন। এই Bopp তুলনামূলক ভাষাবিজ্ঞানের জনক বলে পরিগণিত হ’ন।

         ১৮৫২-৭৫ সালের মধ্যে সংস্কৃত ভাষা বোঝা ও অনুবাদের জন্য দুই প্রখ্যাত জার্মান পণ্ডিত O.von. Boehtlingk এবং R. Roth এর তত্ত্বাবধানে প্রস্তুত হয় বৃহদাকার St. Petersburg Dictionary, ইংরেজীতে অনূদিত হয়ে যেটি ভারতবর্ষে প্রকাশিত হয়েছে । পরবর্তিকালে ১৮৭৯-৮৯ সালের মধ্যে Boehtlingk সংস্কৃত-জার্মান সংক্ষিপ্ত আর একটি অভিধান প্রস্তুত করেন । ১৯৭৫ সালে নতুন অন্য একটি অভিধান প্রস্তুত করেন K. Mylius. বৌদ্ধ সংস্কৃতের অভিধান Goettingen বিশ্ববিদ্যালয় থেকে প্রকাশিত হয় G.von Simon এর সম্পাদনায়।

২) ভারতবর্ষ এবং জার্মানীর সাংস্কৃতিক সম্পর্ক ও বিদ্যাবিনিময়-

         ভারতবর্ষের সঙ্গে জার্মান ভারততত্ত্ববিদদের সম্পর্কের কথা বলতে গেলে প্রথমেই নাম করতে হয় Heinrich Roth এর (১৬২০-১৬৬৮)। আগ্রার মুগল রাজসভায় তিনি ছিলেন একজন খৃষ্টান যাজক ও ধর্মপ্রচারক, ইওরোপীয়দের মধ্যে সর্বপ্রথম যিনি সংস্কৃত ভাষাশিক্ষা করেছিলেন এবং সংস্কৃতভাষার ব্যাকরণ প্রণয়ন করেছিলেন। দুবার সড়কপথে ভারতবর্ষে আসার জন্য তিনি বহু কষ্ট সহ্য করেন।

         ১৬১৮ থেকে ১৬৪৮ এই ‘ত্রিশ বছরব্যাপী যুদ্ধে’র গোড়ার দিকেই ১৬২০ সালের ১৮ ডিসেম্বর জার্মানীর Dillingen শহরে আইনজ্ঞ পিতার ঘরে তাঁর জন্ম হয়, ১৬৩৯ সালে তিনি খৃষ্টধর্ম বরণ করেন এবং এর ১০ বছর পরে ধর্মযাজক বৃত হ’ন । এক সুইডিস সেনার হাতে প্রায় মৃত্যুবরণের সম্মুখীন হয়ে অল্পের জন্য প্রাণে বেঁচে গেলে সুস্থ হয়ে ধর্মপ্রচারক (missionary) হওয়ার সিদ্ধান্ত নেন!

         ইতালীর Livorno থেকে শুরু করে Turkey র Smyrna হয়ে পার্শিয়ার রাজধানী Isfahan এ পৌঁছান। ইথিওপিয়া তখন ক্যাথলিক ধর্মপ্রচারকদের কাছে নিষিদ্ধ থাকায় তিনি ১৬৫২ সালে গোয়ায় আসেন এবং সেখানে অন্য অনেক ভাষার সঙ্গে কন্নড়, Persian এবং উর্দু ও শেখেন। পরে আগ্রায় যান এবং খৃষ্টান একটি কলেজের প্রধান হ’ন। এখানেই সংস্কৃতভাষা শিখে ব্রাহ্মণ পণ্ডিতদের সঙ্গে বিদ্যাচর্চায় অবতীর্ণ হ’ন, পরে সংস্কৃতভাষার গুরুত্ব বুঝতে পেরে ১৬৬০ থেকে ১৬৬২ সালের মধ্যে সংস্কৃত ব্যাকরণ রচনা করেন যাতে পাণিনি ব্যাকরণশিক্ষার বিশেষ নৈপুণ্যের পরিচয় এবং বিশদ বিবরণ ছাড়াও ব্যাখ্যানভাগ আছে ল্যাটিনে। হাতে লেখা পুঁথি Rome এ নিয়ে যাওয়া হলেও সেটিকে প্রকাশযোগ্য করার মত সময় Roth এর হাতে না থাকায় সেটি কখনই প্রকাশিত হয়না যদিও বেশ কিছু পণ্ডিত এবং স্বয়ং Austria র সম্রাট সেটি প্রকাশ করতে ইচ্ছুক ছিলেন।

         Roth সংস্কৃতভাষাকে মন দিয়ে পড়েছিলেন তাই শুধু নয়, সংস্কৃত সাহিত্য এবং ভারতীয় দর্শনে প্রগাঢ় পাণ্ডিত্য লাভ করেছিলেন, এ কথা বলেছেন আর এক খৃষ্টান পণ্ডিত Athnasius Kircher, যিনি Roth এর সঙ্গে সাহিত্যচর্চা করেছেন এবং Vatican Library তে Roth প্রণীত কিছু রচনার পাণ্ডুলিপি সংরক্ষিত করেছেন। এর একটি হলো ১৬৪৪ সালে লিখিত ছন্দোবদ্ধ একটি কোষ- বেণীদত্তের পঞ্চতত্ত্বপ্রকাশ এবং অপরটি পঞ্চদশ শতকের শেষদিকের দর্শনবিষয়ক নিষ্কর্ষ গ্রন্হ (compendium) বেদান্তসার । Roth এর অপর রচনা যা বিশেষ জনপ্রিয় ও পণ্ডিত মহলে সমাদৃত হয়েছিল ভগবান বিষ্ণুর দশ অবতারের ওপর প্রবন্ধ যেটি Kircher এর গ্রন্হ “China illustrata” গ্রন্হের একটি অধ্যায়!

৩) ১৬৬২ সালে দুজন খৃষ্টান ধর্মযাজক পিকিং (বর্তমান Beijing) থেকে Lhasa এবং কাঠমাণ্ডু হয়ে শীতের হিমালয়ের আবহাওয়ায় আগ্রায় পৌঁছলেন যাঁদের মধ্যে একজন পথশ্রমজনিত ক্লান্তিতে প্রাণত্যাগ করেন। ফলে সিদ্ধান্ত হয় যে অপর অভিযাত্রী Johannesburg Grueber এর সহযাত্রী হয়ে Rome এ যাবেন স্বয়ং Roth. এই Grueber ছিলেন পিকিং এর সভার জ্যোতির্বিজ্ঞানী যেখানে ১৩০৭ সালে Archbishop এর কার্যালয় স্থাপিত হয় এবং তিনিই সর্বপ্রথম তৎকালীন তিব্বতের নগর সভ্যতা এবং সংস্কৃতির বিষয়টি সর্বসমক্ষে আনেন। তিনি সড়কপথে পদব্রজে ৪০,০০০ কিমি অতিক্রম করে গুরুত্বপূর্ণ অভিযাত্রীর খ্যাতিলাভ করেন।

         এই Grueber আর Roth সড়কপথে Rome যাত্রা করেন এবং এক বছরের অধিককাল পরে সেখানে পৌঁছান । তাঁদের বক্তব্যে ভারতবর্ষ থেকে চীনের যাত্রাপথ সমুদ্রপথের থেকে সড়কপথ বেশী পছন্দের ছিলো যা নাকি কর্তৃপক্ষ কর্তৃক রাজনৈতিক কারণে পরিত্যক্ত হয়, ৬০০ জন ধর্মযাজক যাঁরা পূর্বের দেশগুলোর উদ্দেশ্যে সমুদ্রপথে রওনা হয়েছিলেন মাত্র তাঁদের মধ্যে মাত্র ১০০ জন ১৬৯০ সালে তাঁদের গন্তব্যে পৌঁছোতে সক্ষম হ’ন বাকীরা জলদুস্য কবলিত হয়ে প্রাণ হারান, এতৎসত্ত্বেও পর্তুগীজদের পরিকল্পিত সমুদ্রপথই মনোনীত হয় । Roth এবং Grueber কে ভারতবর্ষে ফেরৎ পাঠানো হয় এবং পরে তাঁরা Persia যাওয়ার পথে রাশিয়ার মধ্যে দিয়ে রওনা হ’ন কিন্তু রাশিয়ার এক আন্দোলনের সম্মুখীন হয়ে তাঁদের Turkey তে ফিরতে হয় যখন Grueber ভগ্নস্বাস্থের জন্য Istanbul এ অবস্থান করেন এবং অবশেষে পরবর্তিকালে অবশেষে Rome এ পৌঁছান । বন্ধুকে বিদায় জানানোর আকস্মিকতায় Roth তাঁর গ্রন্হের পাণ্ডুলিপিগুলি সেখানে ফেলে যান এবং ওগুলো ওখানেই পোপের সংরক্ষণাগারে স্থান পায় এবং সম্প্রতিকালে সেগুলি প্রকাশ করার পরিকল্পনা করা হয়। Roth একলাই তাঁর যাত্রা অব্যাহত রাখেন এবং Turkey, Armenia এবং Persia র মধ্যে দিয়ে অবশেষে ১৬৬৬ সালে আগ্রা এসে পৌঁছোন যেখানে ২ বছর পরে তিনি দেহত্যাগ করেন॥

কৃতজ্ঞতা :  STACHE-ROSEN, VALENTINA. GERMAN INDOLOGISTS. INDIA: DIALOGUE, 1980.

* অধ্যাপিকা, বেদ ভবন, রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয়।