স্বামী বিবেকানন্দ ও রবীন্দ্রসঙ্গীত
– অশোক দাশ *
নরেন্দ্রনাথ দত্ত তথা বিবেকানন্দ গীত রবীন্দ্রসঙ্গীত – এই বিষয়ে কিছু বলতে গেলে ভূমিকা হিসাবে কয়েকটি তথ্য জেনে রাখা প্রয়োজন।
১৮৮০ সালের ডিসেম্বর মাসে ১৮ বৎসর বয়সের নরেন্দ্রনাথ দত্ত উঃ কলকাতার সিমলা অঞ্চলের তাঁর বন্ধু সুরেন্দ্রনাথ মিত্রের গৃহে শ্রীরামকৃষ্ণকে প্রথম দেখেন ও নিম্নলিখিত দুইটি গান শোনান।
১) প্রথম গানটি অযোধ্যানাথ পাকড়াশী রচিত “ মন চল নিজ নিকেতনে ”
২) দ্বিতীয় গানটি বেচারাম চট্টোপাধ্যায় রচিত “ যাবে কি হে দিন বিফলে চলিয়ে ”
এর পরে নরেন্দ্রনাথ তথা স্বামীজি শ্রীরামকৃষ্ণকে বিভিন্ন সময়ে মোট ৫০ টিরও বেশী গান শুনিয়েছেন। এবং তার মধ্যে বেশ কয়েকটি রবীন্দ্রনাথ রচিত সঙ্গীত।
উল্লেখ্য যে সঙ্গীতের মাধ্যমেই স্বনামধন্য এই দুইটি পুরুষের মধ্যে যোগাযোগ উনবিংশ শতকের বঙ্গীয় রেনেশাঁশের ইতিহাসে অবশ্যই এক বিশিষ্ট মাহেন্দ্রক্ষণ।
রবীন্দ্রনাথ তাঁর শ্রেষ্ঠ সৃষ্টি – সঙ্গীতের মাধ্যমে আমদের জীবনের প্রত্যেকটি অনুভূতিকে ছন্দে ও সুরে প্রকাশ করে জীবনকে যে প্রভাবিত ও আপ্লুত করেছেন সেই সঙ্গীত কি ভাগবতী তনু অবতারবিশিষ্ট শ্রীরামকৃষ্ণকে স্পর্শ করেছিল ? এইটিই এই লেখার আলোচ্য বিষয়।
উঃ কলিকাতার বিখ্যাত গায়ক বেণীওস্তাদের সুযোগ্য শিষ্য নরেন্দ্রনাথ দত্ত(বিবেকানন্দ) অত্যন্ত ভাল গায়ক ছিলেন ও বিভিন্ন ধরনের শাস্ত্রীয় ও অন্যান্য গান গাইতেন ও তিনিই একমাত্র ব্যক্তি যিনি শ্রীরামকৃষ্ণকে রবীন্দ্রসঙ্গীত শুনিয়েছিলেন। উনবিংশ শতকের দ্বিতীয়ার্ধের এক বিশেষ সময়ে গানের মাধ্যমে শ্রীরামকৃষ্ণ , স্বামী বিবেকানন্দ ও রবীন্দ্রনাথ – এই তিন লোকোত্তর ব্যক্তিত্বের আধ্যাত্মিক মেলবন্ধন হয়েছিল – এটি একটি সত্য। অনবদ্য সঙ্গীতগুলির রচয়িতা ও সুরকার রবীন্দ্রনাথ, গায়ক নরেন্দ্রনাথ তথা স্বামী বিবেকান্দ ও শ্রোতা স্বয়ং শ্রীরামকৃষ্ণ।
অল্প বয়স থেকেই ঈশ্বরানুরাগী নরেন্দ্রনাথ ব্রাহ্মধর্মের প্রতি আকৃষ্ট হয়ে কলিকাতার ব্রাহ্মসমাজে যাতায়াত শুরু করেন ও ঘটনাচক্রে রবীন্দ্রনাথের কাছেই তিনি প্রথম ব্রহ্মসঙ্গীত শোনেন ও শেখেন অর্থাৎ এই সঙ্গীতের মাধ্যমেই উভয়ের পরিচয়ের সূত্রপাত। “ কথামৃত ” বইটির তথ্য অনুযায়ী বিবেকানন্দ মোট ছয়দিন শ্রীরামকৃষ্ণকে রবীন্দ্রসঙ্গীত শুনিয়েছিলেন। ক্রমানুসারে বলা যায় –
১) ১৮৮৩ সালের ৭ই এপ্রিল বাগবাজারের বলরাম বসুর বাড়িতে জয়জয়ন্তী রাগাশ্রয়ী “ গগনের থালে রবিচন্দ্র দীপক জ্বলে ” এই গানটি নরেন্দ্রনাথ শ্রীরামকৃষ্ণকে প্রথম শোনান। গানটি গুরুনানক রচিত একটি বিখ্যাত ভজনের আক্ষরিক অনুবাদ।
২) এই গানটি নরেন্দ্রনাথ শ্রীরামকৃষ্ণকে পুনরায় শোনান ৯/৫/১৮৮৫ সালে।
৩) ১৪/৯/৮৪ তে বিবেকানন্দ দক্ষিণেশ্বরে শ্রীরামকৃষ্ণকে রবীন্দ্রনাথের বিখ্যাত ব্রহ্মসঙ্গীত “ দিবানিশি করিয়া যতনে হৃদয়েতে রচেছি আসন ” গানটি শোনান।
৪) ১৪/৭/৮৫ ও ২৪/১০/৮৫ সালে নরেন্দ্রনাথ রবীন্দ্রনাথের দুইটি অসাধারন গান শোনান “ তোমারেই করিয়াছি জীবনের ধ্রুবতারা , এ সমুদ্রে আর কভু হব নাকো পথহারা ”। ওইদিনই বিবেকানন্দ আর একটি রবীন্দ্রসঙ্গীত শ্রীরামকৃষ্ণকে শুনিয়েছিলেন “ মহাসিংহাসনে বসি শুনিছ হে বিশ্বপতি ”।
৫) ১১/৩/৮৫ ও ১৮/৪/৮৬ তে বিবেকানন্দ শ্রীরামকৃষ্ণের সামনে ভাবে বিভোর হয়ে গাইলেন – “ দুঃখ দূর করিলে দরশন দিয়ে ” – রবীন্দ্রনাথের এই ব্রহ্মসঙ্গীতটি ।
৬) ২৭/১০/৮৫ তে বিবেকানন্দ গাইলেন “ একি এ সুন্দর শোভা ” ।
৭) ৭/৫/৮৭ সালে শ্রীরামকৃষ্ণ বিবেকানন্দের কণ্ঠে শুনলেন “ আমরা যে শিশু অতি ”।
উল্লেখ্য তথ্য :
১) দার্শনিক, ভারততত্ত্ববিদ ও সুফী আচার্য্য ক্ষিতিমোহন সেন ( অমর্ত্য সেনের পিতামহ ) কাশীতে বিবেকানন্দের কণ্ঠে তিনটি রবীন্দ্রসঙ্গীত শোনেন ১৮৯০ ও ১৮৯২ সালে। “ একি এ সুন্দর শোভা ” , “ সখী আমারই দুয়ারে কেন আসিল ” এবং “ মরিল মরি আমায় বাঁশিতে ডেকেছে কে? ”
২) ১৮৯৯ সালে বিবেকানন্দের ২য় বার পাশ্চাত্য ভ্রমণের শেষে সিস্টার নিবেদিতার বোসপাড়ালেনের বাড়িতে চা পানের আসরে রবীন্দ্রনাথ তিনটি গান করেন , তার ভিতর একটি – “ বেলা গেল তোমার পথ চেয়ে ”।
কৃতজ্ঞতা স্বীকার : উদ্বোধন পত্রিকা ।
* প্রাক্তন ইঞ্জিনিয়ার, সি.ই.এস্.সি.