পশ্চিমবঙ্গের আধুনিক সংস্কৃত সাহিত্যাকাশে ঋতা চট্টোপাধ্যায় ও তাঁর লিখিত একটি গ্রন্থের পুনর্মূল্যায়ন
*অভিষেক দাস
ঋতা চট্টোপাধ্যায় আধুনিক সংস্কৃত সাহিত্যে এক বিশিষ্ট নাম। জন্ম হয়েছিলো ১৯৫২ সালে, উত্তর কলকাতার এক বনেদি পরিবারে। খুব মেধাবী ছাত্রী ছিলেন। বিদ্যালয় স্তরে এবং উচ্চ শিক্ষাতেও বিশেষ কৃতিত্ব স্থাপন করেছিলেন। বেথুন কলেজ থেকে সংস্কৃত অনার্স, কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে প্রথমে এম.এ এবং পরে পি.এইচ.ডি ডিগ্রি লাভ করেন। কর্মজীবন শুরু করেন উইমেন্স কলেজ ক্যালকাটা (১৯৮০-৯৫) থেকে। তারপর রবীন্দ্রভারতী(১৯৯৫-২০০২) শেষে যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয় (২০০২-২০১৭) থেকে অবসর গ্রহণ করেন। বিশ্ববিদ্যালয় অনুদান আয়োগ(University Grants Commission/UGC) থেকে এমিরিটাস্ ফেলো হিসেবে নিযুক্ত হয়েছিলেন (২০১৭-১৯)। তাঁর প্রতিভার সৌরভ দেশের গন্ডী অতিক্রম করে বিদেশে পৌঁছেছিলো। বিদেশের একাধিক বিশ্ববিদ্যালয়ে বক্তৃতা দিয়েছেন। ২০০৮-০৯ সালে আয়ুর্বেদে গবেষণার জন্য ষোলো হাজার মার্কিন ডলার পুরস্কার পেয়েছিলেন। পরিচিতির জগত ছিলো বিরাট। প্রসিদ্ধ ও খ্যাতনামা অধ্যাপকদের সাথে তার ব্যক্তিগত আলাপচারিতা ছিলো। তাঁর অধীনে বহু গবেষণা হয়েছে। বহু অজানা বিষয় তিনি জগতের সামনে তুলে ধরেছেন। অনেক গবেষণাপত্রের পরীক্ষক ছিলেন। তাঁর স্নেহধন্য ছাত্রছাত্রীরা আজ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে যুক্ত।
গবেষণা প্রসূত পুস্তকের সংখ্যা একাধিক (চব্বিশের বেশি)। কয়েকটির নাম উল্লেখ করা হলো-
১. বিদুষী বঙ্গনারী রমা চৌধুরী
২. শতবর্ষে কবি নিত্যানন্দ
৩. পণ্ডিত শ্রীজীব ন্যায়তীর্থের সারস্বত সাধনা
৪. G B Palsule
৫. সীতানাথ আচার্য, কবি ও প্রাবন্ধিক
৬. মহামহোপাধ্যায় হরিদাস সিদ্ধান্তবাগীশের সারস্বত সাধনা
৭. সিদ্ধেশ্বর চট্টোপাধ্যায় (বুড়োদা)
৮. 20th Century Sanskrit Literature A glimpse into Tradition and Innovation
৯. আধুনিক সংস্কৃত কাব্য ঃ বাঙালী মনীষা শতবর্ষের আলোকে
১০. আধুনিক সংস্কৃত সাহিত্য(১৯১০-২০১০) : ছোটগল্প ও নাটক।
মৃত্যুর কিছু দিন পূর্বে তিনি একটি সংকলনগ্রন্থ প্রকাশ করেন। নিত্যানন্দের নামাঙ্কিত এই গ্রন্থে নিত্যানন্দ বিষয়ক রচনা ছাড়া ও আরো কয়েকটি রচনা স্থান পেয়েছে। সংকলনগ্রন্থের নাম, Nityananda Smrititirtha (1923-2008) A Century Commemoration Volume.
বেশ কিছু পুরস্কার পেয়েছিলেন।
গ্রিফিথ মেমোরিয়াল প্রাইজ (১৯৮১)ইত্যাদি। তিনি কোরিয়ার পস্কো দ্বারা নির্বাচিত ভারতীয় ফেলো। সি.আই. আই.এল্ ফেলো ইত্যাদি সম্মান পেয়েছিলেন।
কলকাতার দীনেন্দ্রনাথ স্ট্রীটে বিরাজমান সংস্কৃত সাহিত্য পরিষদের আজীবন সদস্যা ছিলেন। পরিষদের জন্য নিঃসন্দেহে বহু কাজ করেছিলেন।
ব্যক্তিগত আলাপচারিতা থেকে জানা যায়, পণ্ডিত কালিদাস ভট্টাচার্যের কাছে তিনি বিদ্যাভ্যাস করতে যেতেন। সংস্কৃত কলেজের বিষ্ণুপদ চক্রবর্তী, ভাটপাড়া টোলের প্রথিতযশা পণ্ডিত শ্রীজীব ন্যায়তীর্থ, বর্ধমান বিশ্ববিদ্যালয়ের সিদ্ধেশ্বর চট্টোপাধ্যায়, হাওড়া সংস্কৃত সাহিত্য সমাজের প্রতিষ্ঠাতা নিত্যানন্দ মুখোপাধ্যায়, রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বনামধন্যা উপাচার্যা রমা চৌধুরী, কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের আশুতোষ অধ্যাপক সীতানাথ আচার্য প্রমুখদের সাথে তাঁর সুসম্পর্ক ছিলো।
সেই সব প্রাতঃস্মরণীয় পণ্ডিত ব্যক্তিবর্গ( মূলতো পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যের) যাঁরা শিক্ষা বিস্তারে ও সারস্বত চর্চায় উল্লেখযোগ্য স্থান অধিকার করেছিলেন, তাঁদের প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়েছিলেন অধ্যাপিকা চট্টোপাধ্যায়।
একাধিক গ্রন্থে, পত্রিকায় তার সেই সব রচনা প্রকাশিত হয়েছে।
তার গ্রন্থরাজির মধ্যে থেকে শতবর্ষে কবি নিত্যানন্দ (১৯২৩-২০০৮) শীর্ষক গ্রন্থ সম্বন্ধে কয়েকটি কথা আলোচনা করা হলো।
২০২১ সালের প্রজাতন্ত্র দিবস অর্থাত্ ২৬শে জানুয়ারি গ্রন্থ টি সংস্কৃত পুস্তক ভান্ডার থেকে প্রথম প্রকাশিত হয়। গ্রন্থ টিতে একশ’ আঠাশ ( ১২৮ ) টি পৃষ্ঠা আছে। প্রচ্ছদ অঙ্কন করেছিলেন, সুযোগ্যা কন্যা ড সৌম্যনেত্রা চট্টোপাধ্যায় মুন্সী। উতসর্গ করেছিলেন নিজের আদরের নাতনি কে। পরিবারের গুরুত্ব সর্বাধিক ছিলো অধ্যাপিকা ড ঋতা-র কাছে, তা বলাই বাহুল্য। গ্রন্থে পাঁচটি অধ্যায় আছে।
সূচীপত্রের প্রথমে সংকেতসূচী, নিত্যানন্দ-প্রশস্তিঃ, প্রাগ্ভাষ থেকে বংশ তালিকা সব কিছুর উল্লেখ আছে।
প্রথম অধ্যায়ের বিষয় হলো কবির ব্যক্তিজীবন ও সারস্বত চর্চা।
দ্বিতীয় অধ্যায়ে অধ্যাপিকা ঋতা অধ্যাপক নিত্যানন্দ মুখোপাধ্যায়ের সুবিশাল রচনাশৈলীর বিষয় আলোচনার মাধ্যমে বিন্দুতে সিন্ধু দর্শন করিয়েছেন।
তৃতীয় অধ্যায়ের বক্তব্য বিষয় কবির কাব্যকৃতি।
চতুর্থ অধ্যায়ে নিত্যানন্দ কৃত প্রবন্ধাদির উল্লেখ ও সম্পাদনা বিষয়ে সমালোচনা করেছেন।
পঞ্চম অধ্যায়ে নিত্যানন্দের বাচনরীতি বিষয়ে মনোজ্ঞ আলোচনা করে উপসংহার ঘোষণা করেছেন। এরপর প্রসঙ্গ কথা, সূক্তি, নির্বাচিত সহায়ক গ্রন্থপঞ্জী, নির্ঘন্ট সবশেষে চিত্রসূচীর মাধ্যমে গ্রন্থের সমাপ্তি হয়েছে। আকারে ক্ষুদ্র হলেও গ্রন্থের বক্তব্য শাশ্বত ও সুদূরপ্রসারী। কবি নিত্যানন্দের জীবন ও কার্যাবলী এর মধ্যে দিয়ে মূর্ত হয়ে উঠেছে। অধ্যাপিকা পূর্বে এই বিষয়ে বিভিন্ন পুস্তকে সংক্ষেপে আলোচনা করলেও এটি প্রথম নিত্যানন্দ সম্পর্কিত বাংলা ভাষায় রচিত পূর্ণাঙ্গ গ্রন্থ।
নিত্যানন্দ মুখোপাধ্যায় আধুনিক সংস্কৃত সাহিত্যের ইতিহাসে এক উজ্জ্বল নাম। প্রাচীন আদর্শ, পরম্পরা ও আধুনিক মনস্কতা একত্রে গঠিত হয়েছিলো কবির রচনার প্রেক্ষাপট।
ঋতা চট্টোপাধ্যায়ের আধুনিক সংস্কৃত সাহিত্যে বিশেষ অবদান ছিলো। সমসাময়িক ক্ষেত্রে যাঁরা বিভিন্ন বিষয়ে মৌলিক রচনা সৃষ্টি করেছিলেন, সেগুলো তিনি সংগ্রহ করেছিলেন। যথাযোগ্য মর্যাদায় ও সমাদরের সাথে সেগুলো সাজিয়ে তুলে দিলেন উত্তরসূরীদের হাতে।বিশেষ তো তিনি যোগসূত্রের কাজ করেছিলেন অতীতের সঙ্গে আধুনিকের। যে সব মণিমুক্তা বিচ্ছিন্ন হয়ে অবস্থান করছিলো, তাঁদের তিনি সযত্নে গাঁথলেন। সূত্রস্য মে গতিঃ। তাঁর গ্রন্থগুলি এক অর্থে জীবন্ত দলিল। সত্তর-আশির দশকের সংস্কৃত সাধকদের কথা বাংলা ও ইংরেজি উভয় ভাষাতেই প্রকাশিত হয়েছে। তাঁদের মধ্যে অনেকেই প্রীতি বশতঃ অধ্যাপিকা চট্টোপাধ্যায় কে শুভেচ্ছা জানিয়েছিলেন। গ্রন্থে তাঁদের কথা উল্লেখ করেছেন।
* সহকারী অধ্যাপক, বিবেকানন্দ কলেজ, ঠাকুরপুকুর, কলকাতা