“ওয়াটার – ড্রপ- লেট” এর সেকাল একাল

– মৃত্যুঞ্জয় চক্রবর্তী**

প্রাচীনকাল হতে ব্রহ্মবিন্দর সম্বন্ধে স্পর্শকাতর ছিল সমাজ। মুখ থেকে বেরিয়ে আসা জলকণা পাশাপাশি অবস্থানকারীদের কাছে ছড়িয়ে পড়তে না পারে তার ব্যবস্থা সম্বন্ধে ওয়াকিবহাল ছিল তারা। তখনও ভাবা হতো এই জলকণা অন্যদের ক্ষতি করতে পারে। শুধু তাই নয় দেবতাদের পূজার্চনায় ও ভোগ নিবেদনের সময় খুব সতর্ক থাকতেন। যিনি ভোগ রন্ধন করতেন, তিনি মুখ ও নাক ঢেকে রন্ধনাদির কাজ করতেন।এমন কি যিনি ভোগ বহণ করে দেবতার কাছে পরিবেশন করতেন, তিনিও মুখ ও নাক ঢাকা রাখতেন, মুখের জলকণা ও নাকের দ্বারা ঘ্রাণ গ্ৰহণ যাতে করতে না পারেন। কথিত আছে—‘ ঘ্রাণেন অর্ধভোজনম্’ তাই নাক চাপা দিতেন। এমনকি ভোগ নিবেদনের সময়ও পূজক ভোগ হতে নির্দিষ্ট দূরত্বে অবস্থান করতেন বা নিবেদনের আগে ঘ্রাণ নাক পর্যন্ত না যায় , সেভাবে অবস্থান করতেন।

যজ্ঞের হোমাদি সম্পাদনের সময় ব্রহ্মবিন্দর সম্বন্ধে হোতারা সতর্ক থাকতেন । অগ্নি প্রজ্বলনের পর ইন্ধনের চাপে অগ্নি নিভে আসত।,তখন সরাসরি ফুঁ দিয়ে অগ্নি প্রজ্বলন করা যেত না বা যজ্ঞ চলাকালীন হোমাগ্নিতে জল বা জলকণা দেওয়া যেত না। তারজন্য দুহাত মুক্ত অঞ্জলির মতো করে ফুঁ দিতে হয়, হাতের মুক্ত অঞ্জলিতে ধাক্কা খেয়ে ফুঁ বাতাস অগ্নি প্রজ্বলনে সাহায্য করত।এই ফুঁ এর সঙ্গে জড়িত জলকণা (ওয়াটার ড্রপ লেট) বা ব্রহ্মবিন্দর হাতে আটকে যেত , আর শুধু বাতাস অগ্নি প্রজ্বলনে সহায়ক হত। এই ‘ওয়াটার ড্রপ লেট’ হল সাধু ভাষায় ব্রহ্মবিন্দর। এ বিষয়ে একটি পুরাতাত্ত্বিক ঘটনার অবতারণা করা যেতে পারে। দ্বাপর যুগে যখন রাজা নন্দের জায়া যশোদা দেবী যশোদাঙ্গনে কাজে ব্যস্ত ছিলেন এবং অদূরে অতি দুরন্ত নন্দের নন্দনকে দড়ি দিয়ে বেঁধে রেখে ছিলেন। গৃহ কাজে ব্যাঘাত ঘটাতে না পারে বলে, এইভাবে নিদারুণ অবস্থায় শিশুটিকে বেঁধে রাখতেন। এইরূপে একদিন যশোদা দেবী তাঁর এক ব্রত উৎযাপন  করার জন্য ব্রাহ্মণ  ভোজনের মনস্থ করলেন। ব্রাহ্মণ ভোজনের জন্য মহাত্মা কণ্ব মুনিকে ব্রাহ্মণরূপে আহ্বান জানিয়ে আমন্ত্রণ করলেন।কণ্বমুনিও তাঁর ‌আমন্ত্রণে  সাড়া দিয়ে যশোদাঙ্গনে পৌঁছলেন। যশোদা দেবীও মুনিকে যথাযোগ্য মর্যাদায় সম্মান প্রদর্শন করে শুদ্ধ-শাক্ত ও পরিপাটি করে ব্রাহ্মণভোজনের আয়োজন করলেন। কণ্ব মুনির কাছে ভোজনের জন্য যথাবিধি ভোজন দ্রব্যাদি সম্ভ্রবের সঙ্গে   পরিবেশন করলেন।কণ্বমুনি ভোজনের আগে দেবতাদের উদ্দেশ্যে নিবেদনের নিমিত্ত পঞ্চগ্ৰাস মুদ্রায় নিবেদন করলেন। তৎক্ষণাৎ অতি দুরন্ত নন্দের নন্দন অদূরে দড়ি খুলে কণ্বমুনির নিবেদনের পাত্র হতে মিষ্টান্ন তুলে কিছু খেয়ে সেই পাত্রে  রেখে চলে গেল।এই শিশুর উচ্ছিষ্ট  হওয়ায় কণ্বমুনি কুপিত হলেন। মা যশোদাও ভয়ে এবং লজ্জিত হয়ে মুনির নিকট  ক্ষমা প্রার্থনা করলেন।অনুনয় বিনয় করে তাঁকে ক্রুদ্ধ ও অভিশাপ দানে বিরত থাকতে অনুরোধ জানালেন।মুনিও ঘটনার আকস্মিকতায় অবাক হয়ে যশোদা দেবীর অনুনয়ে সাড়া দিলেন। মা যশোদা ও সমস্ত উচ্ছিষ্ট খাদ্যদ্রব্য পরিষ্কার করে, নতুন করে কণ্বমুনির ভোজন নিমিত্ত উৎকৃষ্ট খাদ্য দ্রব্যাদি তাঁর সামনে উপস্থাপন করলেন। ঠিক একই ভাবে কণ্বমুনি ভোজনের আগে খাদ্যাদি নিবেদন করলেন। যথারীতি শক্ত দড়িবন্ধনে আবদ্ধ নন্দের নন্দন বন্ধনমুক্ত হয়ে পঞ্চগ্ৰাসে নিবেদিত ভোজন পাত্রের খাদ্যদ্রব্য পূর্বের মতো নির্দিধায় উচ্ছিষ্ট করে দিলেন। এতে কণ্বমুনি খুব্ধ ও আশ্চর্যান্বিত হলেন এবং যশোদাকে তিরস্কার করলেন।পরে ঘটনার আকস্মিকতায় তিনি ধ্যানস্থ হয়ে সব অনুধাবন করলেন। এবারে আরো অধিক ভীত সন্ত্রস্ত হয়ে যশোদা দেবী কণ্বমুনির একেবারে পায়ে পড়ে শিশুর দোষ ত্রুটি মার্জনা পূর্বক সাশ্রুনয়নে করোজোড়ে তাঁর কৃপা প্রার্থনা করলেন। নিজের শিশুর আয়ত্ত না করতে পারার অপরাধে ও লজ্জায় কণ্বমুনির দিকে তাকিয়ে লক্ষ্য করলেন, ব্যাপারটা বুঝলেন কিছুটা শান্ত হয়েছেন মুনি, এইভেবে নিয়ে দ্রুততার সঙ্গে অন্য উৎকৃষ্ট ভোজন সামগ্ৰী অনুরোধ উপরোধ করে পুনরায় মুনির সম্মুখে সুচারুভাবে রাখলেন। কণ্বমুনি ও তাঁর অভ্যাস মতো ঈশ্বরের উদ্দেশ্যে নিবেদনের মাধ্যমে চক্ষু মুদ্রিত করে থাকলেন।এই সময় হঠাৎ করে সদ্য শান্তি প্রাপ্ত শিশু, ক্রন্দনভুলে অদূরে দড়ির বন্ধন খুলে নিমেষের মধ্যে নন্দের নন্দন ঈশ্বরের কাছে নিবেদনের আহ্বানে সাড়া দিয়ে সেই মুনির ভোজনপাত্র হতে নিয়ে মুখে দিয়ে সেই পাত্রে রাখল। কণ্বমুনি তৎক্ষণাৎ সেই শিশুর হাত ধরে ফেললেন।তপসিদ্ধ মহাত্মার বুঝতে বাকি রইল না যে,সে সামান্য শিশু নয় ,সে পরব্রহ্মকৃষ্ণ।পরম করুণাময় প্রেমের ঠাকুর।এ ঘটনার পরে কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে মা যশোদা ক্রন্দনরতা হয়ে ছুটে এসে অকাতরে মুনির পায়ে লুটিয়ে পড়লেন এবং শিশুর কৃতকর্মের জন্য আন্তরিক ভাবে ক্ষমা প্রার্থনা করলেন। মুনিও যশোদা দেবীকে ঘটনার প্রেক্ষিতে আশ্বস্ত করলেন এবং জগদ্বন্ধুর লীলার অনুক্ষণ প্রকাশ করলেন। এই স্মমরণীয় ঘটনার প্রেক্ষিতে একটি শ্লোক অবতারণা করলেন। শ্লোকটি হল

—   “মক্ষিকা-সন্ততি- দার-মার্জার-ব্রহ্মবিন্দরঃ।
বামা- বালা- মুখচ্ছিষ্টং নৈব দূষ্যং কদাচন”।।

অর্থাৎ, মক্ষিকা (মৌমাছি), সন্ততি (সন্তান), দার (স্ত্রী), মার্জার (বিড়াল), ব্রহ্মবিন্দর (ওয়াটার ড্রপ লেট),বামা (স্ত্রীলোক), বালা (বালক বা বালিকা) প্রভৃতির মুখের উচ্ছিষ্ট কখনোও দূষিত হয় না।

এখানে কণ্বমুনি শিশু বা সন্তানের মুখচ্ছিষ্ট দূষিত নয়, অর্থাৎ সে শিশু সামান্য নয় স্বয়ং শ্রীকৃষ্ণের বাল্যরূপ।তাই তাঁর প্রসাদিত খাদ্য দ্রব্যাদি গ্ৰহণে কোনরূপ সংশয় নেই।

তখন থেকে কণ্বমুনির আপ্তবাক্য সমাজে পুরোপুরি ভাবে এর ব্যবহারের যথার্থতা প্রকাশ হতে লাগল। সেহেতু বই বা পুস্তক পাঠকালে মুখের জলকণায় বা পুস্তক কখনো দূষিত হয় না।

বর্তমানে কিন্তু এই ‘ব্রহ্মবিন্দর’ অর্থাৎ’ওয়াটার ড্রপ লেট’ কোভিড-১৯ বা   করোনা ভাইরাস অতিমারী রোগের জীবাণু সংক্রমণের প্রকৃষ্ট মাধ্যম হিসেবে অভিহিত হয়েছে। এই  করোনা ভাইরাস সারা বিশ্বের বিস্ময়! করোনা ভাইরাস এর আক্রমণে বিশ্ববাসীরা দিশেহারা,সন্ত্রস্ত ও বিভ্রান্ত।এই ভাইরাসের প্রকোপে বিশ্বের বিভিন্ন দেশের মানুষে সংক্রমিত হয়ে মৃত্যু মিছিল ত্বরান্বিত করেছে।তাই সম্প্রতি চিকিৎসাবিজ্ঞানীরা অর্থাৎ প্রখ্যাত ডাক্তারগণ, ভাইরাস-গবেষকগণ মনে করেন এই অতিমারী প্রকোপের লেলিহান শিখাকে প্রতিরোধ করতে গেলে মানুষের উচিত এই ‘ওয়াটার ড্রপ লেট’ বিস্তার রোধে প্রত্যেকের মুখে মুখোশ বা মাস্ক ব্যবহার অবশ্য অবশ্যই করণীয়। সেই কারণে এই অতিমারী প্রকোপের রোগ  নিরাময়ে  বিশেষজ্ঞদের পরামর্শ দিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা  ‘সামাজিক দূরত্ব পালন করা, নিভৃত- বাস,শুদ্ধ ও প্রোটিন সমৃদ্ধ খাবার খাওয়া ইত্যাদি।

সনাতনী হিন্দু আচার চলে এসেছে তা ছিল অসম্ভব রকমের বিজ্ঞান ভিত্তিক অভ্যাস। এটা হয়তো তৎকালীন মানুষের অভ্যাস থেকে ঠেকে শেখার অভিজ্ঞতার ফল। সেই অভ্যাস চলে আসছে—নিভৃতবাস(হোমকোয়ারেন্টাইন), সামাজিক দূরত্ব (সোস্যাল ডিস্টেনসিঙ্) মেনে চলা,মাস্ক ব্যবহার করা প্রভৃতি গ্লোবালাইজেশনের মুখে সবাই সকলের আত্মীয়।কোভিড-১৯ বা করোনা ভাইরাস শিক্ষা দিয়েছে প্রাচীনকালের অভ্যাস বা রীতিনীতি বা শাস্ত্রীয়বিধান একেবারে উড়িয়ে দেওয়ার মতো ‌ঘটনা নয়। সারা বিশ্বে মানুষের মৃত্যুমিছিলের সঙ্গে ভারতের মানুষের মৃত্যুমিছিলের সেরূপ ভাবে সামঞ্জস্য বিধান করলে হয়তো একেবারে মিলবে না, তবুও যেকোনো মৃত্যুই অনভিপ্রেত। মৃত্যু সতত দুঃখের। দুঃখের মধ্যেও আশার আলো কিছু মানুষ করোনা প্রকোপের করালগ্ৰাসকে বৃদ্ধাঙ্গুষ্ঠ দেখিয়ে করোনা জয়ী হয়েছেন। তাঁদেরকে অসংখ্য কুর্নিশ ও অভিনন্দন জানাই।

অভ্যাস তার প্রাচীনই হোক বা বর্তমানই হোক তা যদি মানুষের জন্য শুভ হয় তাকেই অনুসরণ করা উচিত। আমদের মধ্যে প্রেয় ও শ্রেয় র মধ্যে শ্রেয়কেই গ্ৰহণ করা উচিত নির্দিধায়। সুতরাং ব্রহ্মবিন্দর বা ‘ওয়াটার ড্রপ লেট’ অগ্নিতে না যাওয়া হোক, পুস্তকাদিতে পড়ুক, ভোগদ্রব্যাদিতে পড়ুক প্রভৃতি আচরণ ছিল হয়তো মুখের জীবাণুর সম্প্রসারণ না করা।তার দ্বারা শাস্ত্ররক্ষার মধ্য দিয়ে স্বাস্থ্যরক্ষার ব্যবস্থা ছিল বা রয়েছে। ধর্মশাস্ত্রকাররা যেমন  এরূপ ব্যবস্থা করেছেন, তেমনি বর্তমানে চিকিৎসা- বিজ্ঞানের বিশেযজ্ঞগণ,গবেষকগণ একইভাবে মুখে মাস্ক পরা, সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখা,প্রোটিনযুক্ত সুষম খাদ্য গ্রহণ করে শরীরকে সুস্থ রাখার উপায়ের সুপরামর্শ দিয়েছেন। তার মাধ্যমে মানুষের এই কোভিড-১৯ বা করোনা ভাইরাস থেকে মুক্ত থাকার দিকদর্শন করিয়ে দিয়ে অতিমারী রোগ হতে বাঁচার জন্য প্রায়োগিক বিজ্ঞানসংক্রান্ত(টেকনিক্যাল) উপদেশ প্রদান করে যাচ্ছেন। সেগুলির দিকে লক্ষ্য রেখে আমাদের সমস্ত পালন করে যেতে হবে নিজেদের স্বার্থে বা সর্বজনীনকল্যাণে।

_____________

* এটি কনভারজেন্স-এর আয়োজনে ‘ভারতীয় ঐতিহ্য: সাহিত্য, সমাজ, সংস্কৃতি ও বিজ্ঞান’ বিষয়ক বক্তৃতামালার দ্বিতীয় বক্তৃতার সারসংক্ষেপ।

** শিক্ষক, হেয়ার স্কুল, W.B.SUB.E.S.