সিরপুর ভ্রমণ

– স্বাতী পারেখ

বর্তমান ছত্তিশগড় প্রাচীন ভারতে ষোড়শ জনপদের মধ্যে কোশল দেশের দক্ষিণ অংশে ছিল। দক্ষিণ কোশল নামেই পরিচিত। ছত্তিশগড়ের রাজধানী রায়পুর। এই রায়পুরে আমার সেজোমামা থাকেন। তাঁর একশোতম জন্মদিন উপলক্ষে আমরা সদলবলে রায়পুর গেলাম। মামা  নৃপেন চৌধুরী এক আশ্চর্য চরিত্র। যত দেখি তত বিস্মিত হ‌ই। একশো বছর বেঁচে আছে শুনলে আমরা  অবাক হ‌ই। মনে ভাবনা আসে— বয়স, বার্ধক্য, অপারঙ্গমতা ইত্যাদি। কিন্তু সাদা ধুতি, পাঞ্জাবি পরিহিত সদ‍্য শতবর্ষ অতিক্রান্ত মানুষটিকে দেখলে মনে হয়, আমরা বোধহয় সেই ব্রিটিশ যুগেই দাঁড়িয়ে আছি, যেখানে বাঙালি তার দৃপ্ত চরিত্রের প্রকাশ ঘটাচ্ছে। প্রবাসে দীর্ঘ বছর থেকেও স্বাধীনতা-উত্তর ভারতের হাজার রকমের পরিবর্তনের মধ‍্যেও মামা সেই স্বাধীনতা সংগ্রামের যুগের মানুষ হয়ে বিস্ময় জাগাচ্ছেন। আধুনিক বিশ্বের সব খবর রাখেন কিন্তু দৈনন্দিন জীবনের রুটিনের কোন হেরফের নেই। অত্যন্ত স্বাবলম্বী, নিজস্ব ব‍্যক্তিগত সব কাজ নিজেই করেন। খাদ‍্যাভ‍্যাস, জীবনযাপনে ষোল আনা বাঙালি। সময়ানুবর্তী ও শৃঙ্খলিত জীবন। চার প্রজন্মের সুন্দর সহাবস্থান দেখে মুগ্ধ হতে হয়। মামার বাড়িই যেন সনাতন ভারতবর্ষ অথচ কোন অহেতুক সংস্কার নেই। পাশ্চাত্য জীবনের যাবতীয় সদ্‌গুণের হাওয়া ব‌ইছে। সকলেই কর্মঠ, আধুনিক প্রযুক্তিতে শিক্ষিত এবং অটুট পারিবারিক বন্ধনে আবদ্ধ। ধান ভানতে শিবের গাজন গেয়ে ফেললাম।

এক অভিনব জন্মদিন পালনের সাক্ষী হতে রায়পুর গেলাম। মামার একশত বছর উদযাপনের উৎসব (7th March 2023)। পরের দিন ছিল হোলি। সেও অভিনব। শতবর্ষের মামাকে নিয়ে চার প্রজন্মের হোলি খেলা অন্তরে চিরস্থায়ী এক সুখকর স্মৃতি হয়ে র‌ইল। 9th March স্থির করা হল, আমরা রায়পুর থেকে ৮৫ কিলোমিটার দূরে সিরপুর গ্রামে যাব।

অত জায়গা থাকতে সিরপুর কেন? প্রত্নতত্ত্ববিদ ও ইতিহাসবিদদের কাছে এ এক তীর্থস্থান। বৈদিক সাহিত‍্যে ছত্তিশগড়ের কোন উল্লেখ নেই। রামায়ণে কোসল রাজ‍্যের উল্লেখ আছে। শ্রীরামচন্দ্রের মা কৌশল‍্যা ছত্তিশগড়ের (কোসল)  রাজা ভানুমন্তের কন‍্যা ছিলেন। যেহেতু ভানুমন্তের কোন পুত্র ছিল না কোসল রাজ‍্য ও কৌশল‍্যার অধিপতি রাজা ভানুমন্ত অযোধ্যা‌র রাজা দশরথের অধীনে ছিল। শোনা যায় বনবাসকালের কিছুদিন  রামচন্দ্র এই ছত্তিশগড়ের অরণ্যে অতিবাহিত করেন।  বাল্মীকির আশ্রমও এই ছত্তিশগড়েই ছিল। নির্বাসিতা সীতা বাল্মীকির আশ্রমেই ছিলেন এবং এইখানেই লব ও কুশের জন্ম হয়। শ্রীরামচন্দ্রের পুত্র কুশ এই দক্ষিণ কোসলের রাজাও ছিলেন।

মহাভারতে ছত্তিশগড়ে‌র উল্লেখ প্রাককোসল নামেই ছিল। অর্জুনের পুত্র বভ্রূবাহনের রাজত্ব ছিল প্রাককোসলে এবং তার রাজধানী ছিল সিরপুরে। ষষ্ঠ শতাব্দীতে ষোলো মহাজনপদের একটি জনপদ কোসল অর্থাৎ ছত্তিশগড় ছিল। ছত্তিশগড়ে ভগবান বুদ্ধের আগমনের প্রমাণ পাওয়া যায়।

প্রায় পঞ্চম শতকে দক্ষিণ কোসলে (ছত্তিশগড়ে) শরভপুরী বংশ রাজত্ব করে। ছত্তিশগড়ে শরভপুরী বংশের সব রাজাই গুপ্তযুগ এবং গুপ্তোত্তর যুগের ছিলেন।

শরভপুরী বংশের পর এই অঞ্চলে পান্ডু বংশীয় রাজ‍্য স্থাপিত হয়। সোম বংশ নামে এই বংশ পরিচিত। রাজা উদয়নের দ্বারা পান্ডু বংশের স্থাপনা। উদয়নের পুত্র ইন্দ্রবল পরাক্রমশালী রাজা ছিলেন। তাঁর চার পুত্রের মধ্যে তিন পুত্রের নাম জানা যায়: নন্ন, ঈশানদেব আর ভবদেব রণকেশী। নন্নের পুত্র তীবরদেব রাজ‍্যের বিস্তার ঘটিয়েছিলেন। তীবরদেবের উত্তরাধিকারী ছিলেন তাঁর ভাই চন্দ্রগুপ্ত। চন্দ্রগুপ্তের পুত্র হর্ষগুপ্তের বিয়ে হয় মগধের মৌরবরি রাজা সূর্য‌বর্মার কন্যা বাসটার সঙ্গে। হর্ষগুপ্তের ছেলে মহাশিবগুপ্ত দীর্ঘদিন রাজত্ব করেন। তিনি মহাশিবগুপ্ত বালার্জুন নামে প্রসিদ্ধ ছিলেন। বালার্জুনের শাসনকালে ওনার মা রানী বাসটা স্বামী হর্ষগুপ্তের স্মৃতিরক্ষার্থে বিষ্ণু মন্দির নির্মাণ করান। সিরপুরে স্থিত এই বিষ্ণু মন্দির লক্ষ্মণ মন্দির নামে খ‍্যাত। মহাশিবগুপ্ত বালার্জুন শৈব ছিলেন কিন্তু ভিন্ন ধর্মের প্রতি উদার মনোভাব পোষণ করতেন। ওনার রাজত্ব‌কালেই চৈনিক পরিব্রাজক হিউয়েনসাঙ এসেছিলেন। তিনি লিখে গেছেন রাজা বালার্জুনের বৌদ্ধ ধর্মের প্রতি আস্থা। তিনি সিরপুরের বৌদ্ধ বিহারের বর্ণনা করে লিখেছেন এই অঞ্চলে ১০০ সংঘারাম আছে, যেখানে ১০ হাজার মহাযানী বৌদ্ধ‌ভিক্ষু বাস করে।

মনে করা হয় ৩৬টি গড় বা কেল্লার জন্য এই অঞ্চল ছত্তিশগড় নামে খ‍্যাত। আবার কেউ কেউ বলেন ছত্তিশগড়ে চেদি বংশের শাসন ছিল। চেদি রাজার নামানুসারে চেদিগড় বলা হত। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে সেটি চেদিসগড়ে রূপান্তরিত হয় এবং অপভ্রংশ হয়ে নাম হয় ছত্তিশগড়।

আমার দাদা সঞ্জয় ভট্টাচার্যের তত্ত্বাবধানে ছত্তিশগড়ে‌র মহাসমুন্দ জেলার সিরপুরে আমরা এসে পৌঁছলাম বেলা বারোটা নাগাদ। সিরপুরে ঢোকার রাস্তা বড় সুন্দর। দুপাশে বড় বড় গাছ। বসন্তের আগমন বার্তা চারিদিকে। পলাশফুলের সমারোহে চারদিক আগুনরঙা। নির্জন মসৃন রাস্তায় গাড়ি চলেছে। সিরপুরে‌র কাছে আসতেই বোঝা গেল এককালে এটি একটি সমৃদ্ধ অঞ্চল ছিল। রাস্তার দুপাশে লাল ইটের কাঠামো। মন্দিরের অবয়ব, ভাঙ্গা স্তম্ভ। হঠাৎ দেখি আমাদের ড্রাইভার বেশ উত্তেজিত। একটা জায়গায় গাড়ি থামিয়ে সে দৌড়ে গেল। যেখানে গাড়ি থামালো, তার পাশেই ASI এর তত্ত্বাবধানে খনন করে পাওয়া স্তূপ। ‘সুরং টিলা’র ভগ্নাবশেষ। বাইরে থেকেই সাদা রঙের পাথরের মন্দিরের কাঠামো বড় সুন্দর লাগছিল। ড্রাইভার শ্রবণকুমার গাড়ি থেকে নেমে একটা বন্ধ বাড়িতে জোরে জোরে ধাক্কা দিল। সাড়াশব্দ না পেয়ে গাড়িতে ফিরে এল। জিজ্ঞেস ক‍রা‌র আগেই বলল, ‘ইয়ে মেরা সসুরাল’। শাশুড়ি একাই থাকেন, চোখে দেখে না, কানে শোনে না। বাড়িতে শাশুড়ি থাকলে দুপুরের খাওয়া‌টা এখানেই খেতে পারত।

দাদাদের গাড়ি এগিয়ে গিয়েছিল। প্রথমে আমরা গেলাম গন্ধেশ্বর মন্দির। গাড়ি থেকে নামতেই টের পাওয়া গেল সূর্যদেবের গরিমা। মন্দিরটি মহানদীর ধারে। বিশাল মহানদী এখন জলশূন‍্য। ছেলে, বুড়ো, মহিলারা পায়ে হেঁটে চলেছে নদীর পরপারে। সাইকেল, স্কুটার নিয়েও চলেছে। কী শান্ত জায়গা! নদী অনেক নীচে। বিশাল চাতাল। বড় বড় গাছের ছাওয়া। মন স্নিগ্ধ হয়ে গেল। মহানদীর তীরে এই মন্দির অত্যন্ত মনোমুগ্ধকর, শৈল্পিক ও ইতিহাস সমৃদ্ধ। এই মন্দিরের ভিতর অত্যন্ত আকর্ষণীয় পুরাতত্ত্বের ধ্বংসাবশেষ। দুর্লভ মূর্তির অনবদ্য সংগ্রহ রয়েছে। বিহার ও প্রাচীন মন্দিরের ধ্বংসাবশেষ পর্যটকদের আকর্ষণ না করে ছাড়ে না। ভূমি স্পর্শ করা বুদ্ধের মূর্তি, তার পাশেই শিবলিঙ্গ, নটরাজ, গরুড়, নারায়ণ, মহিষাসুরমর্দিনীর মূর্তি দুর্লভ ও আকর্ষণীয়। রাবণের এক দুর্লভ মুখের মূর্তি দেখলাম। মন্দিরে ঢোকার মুখে শিবলীলার বহু চিত্র খোদিত রয়েছে। মন্দির চত্বরে বট গাছের ছায়ার নীচে বসে মহানদীর পারিপার্শ্বিক দৃশ্য উপভোগ করলাম।

লাঞ্চ খাওয়ার ব‍্যবস্থা করে আমরা জঙ্গলে ঝরনা দেখার বাসনায় র‌ওয়ানা হলাম। গাইড তেজপাল  লাঞ্চের পরে এসে আমাদের সঙ্গে যোগ দেবেন। ইতিহাস বিনা প্রত্নতত্ত্বের ধ্বংসস্তূপ শুধুই পাথর আর মাটি। গাইডের বাক‍্যনৈপুণ‍্যে মৃত ইতিহাস জেগে ওঠে, ইট, কাঠ, পাথর প্রাণ পায়।

জঙ্গলে‌র পথে বহুদূর যাওয়া হল কিন্তু যৌবনাবতী, বেগবতী ঝরনা কিংবা নিদেন পক্ষে ‘তিরি তিরি ঝোরা’ কোথায়? বন জঙ্গলে‌র মধ্যে রাস্তা অপূর্ব সুন্দর কিন্তু গাড়ি যাওয়ার পথ ক‌ই? দিশাহীন হয়ে দুটো গাড়িই থামল।কয়েকটি বাইক গেল সামনের পথে। তাদের জিজ্ঞেস করে জানলাম তাদের গন্তব্য পথ‌ও ঝরনা। বাইক তবু চলে যাবে, গাড়ি যাওয়ার পথ নেই। খানিক পরে বাইকবাহিনী হতাশ মুখে ফিরে এল। গুগুল বাবাজি বলছে খুব নিকটেই ঝরনা। এদিকে বেলা ক্রমশঃ এগোচ্ছে। ড্রাইভার যুগল জানালো অজানার পথে গিয়ে প্রকৃত দ্রষ্টব্য সিরপুরে যে জন্য আসা তা দেখার সময় হবে  না। খিদেও পেয়েছে সকলের। অত‌এব গাড়ি ঘুরিয়ে সোজা সরকারি রিসর্টে যেখানে দ্বিপ্রাহরিক খাবারের বন্দোবস্ত হয়েছে।

খাওয়া দাওয়া ভালমতো সাঙ্গ হবার পর দেখা গেল গাইডদাদা নির্দিষ্ট সময়ে, নির্দিষ্ট স্থানে এসে অপেক্ষা করছেন।

প্রথমে গেলাম বুদ্ধ বিহারে। সিরপুরকে শ্রীপুরও বলা হত। নামটি যথাযোগ্য ছিল। প্রাচুর্যে ভরপুর ছিল। তীবরদেব ও শিবগুপ্ত বালার্জুনের সময় (ষষ্ঠ থেকে অষ্টম শতক) স্থান‌টি অত্যন্ত সমৃদ্ধ ছিল। মন্দির ও বিহার ছিল সমমর্যাদা‌য়। সেই বুদ্ধ বিহারে ঢুকে তার ভগ্নাবশেষ, মূর্তি ও স্থাপত্য দেখে মুগ্ধ হতে হয়। সিরপুরে ১০০ বিহারের মধ্যে কয়েকটি অবশিষ্ট আছে। এখানে ইটের বানানো দেওয়াল ও অন‍্য অলংকরণ পাথরে খোদিত। এখানে আনন্দ‌প্রভ নামে বৌদ্ধ ভিক্ষু সম্বলিত শিলালিপি পাওয়া গিয়েছে ও ভগবান বুদ্ধেরও অনেক মূর্তি পাওয়া গিয়েছে।

১৮৭১ খ্রীষ্টাব্দে ব্রিটিশ পুরাতত্ত্ব‌বিদরা সিরপুরে মাটির নীচে পুরাকালীন শহরের অস্তিত্বের কথা জানতে পারেন। কানিংহাম ১৮৪টি ‘সাইট’ বা স্থানের কথা বলেন। তার মধ্যে আজ পর্যন্ত ৩৯টি স্থান খনন করা হয়েছে। খননের ফলে দেখা গেল মহানদীর তীরে ইটের বানানো দেওয়াল, পাথরে অলংকরণ করা মন্দির, বিহার আবিষ্কৃত হয়। শিব মন্দিরও পাওয়া যায়। সব‌ই সপ্তম শতকের সময়ের। তোরণে যে নকশা পাওয়া যায়, ভারতবর্ষের অন‍্যত্র কোথাও নেই। (এটা অবশ্য গাইডদাদা মারফত তথ্য) তা শুধু এই সিরপুরেই আছে। তোরণে জাতকের গল্প উৎকীর্ণ। বাঁদর আর কুমীরের গল্প, নকশায় আম গাছ, আম্রপল্লব, খেজুর গাছ, গরুড়, গজলক্ষ্মী, পায়ে পায়েল ও কোমরে কোমরবন্ধ পরিহিত নারী মূর্তি, দ্বারে দ্বারপাল, নারীপুরুষের যুগল মূর্তি, সদ‍্যোজাত বাছুরের গা চেটে দেওয়া মা গাই এর মূর্তি খোদিত তোরণগুলিতে। গাইডদাদা মূর্তি গুলি দেখিয়ে এত সুন্দর ব‍্যাখ‍্যা করছিলেন, মনে হচ্ছিল ঐ সময়ে‌ই আমরা পৌঁছে গিয়েছি। উন্মুক্ত প্রান্তরে  চারিদিকে পাথরের স্তম্ভ, মূর্তি সব কিছু দেখে বিহ্বল হয়ে পড়ার অবস্থা। কিন্তু বিহ্বল হলে তো চলবে না আরও অনেক কিছু দেখবার আছে।

পরের গন্তব্য লক্ষ্মণ মন্দির। এটি আসলে বিষ্ণু মন্দির। ইটের দ্বারা নির্মিত  এই মন্দির ভারতীয় স্থাপত‍্যকলার এক অনন্য উদাহরণ। মন্দিরের বাইরের দেওয়াল আর চূড়াতে উত্তর ভারতের মন্দিরের লুপ্ত শৈলী, উড়িষ্যা আর অন্ধ্রের কলাশৈলীর মিলিত রূপ দেখা যায়। মন্দিরের গর্ভগৃহের প্রবেশদ্বারের ওপর বিষ্ণুর শায়িত মূর্তি ও বিষ্ণুর দশাবতার রূপ উৎকীর্ণ । উৎকীর্ণ কৃষ্ণলীলাও বিশেষ আকর্ষণীয়। দ্বারের ডানদিকের স্তম্ভের একদম নীচে মিথুন মূর্তি। মন্দির শিখরের স্থাপত‍্য বৌদ্ধ চৈত‍্যের আকৃতিতে বানানো। হিউয়েন সাঙের লেখায় এই মন্দিরের উল্লেখ আছে। কানিংহাম সাহেব ১৮৭২ সালে মন্দির‌টি আবিষ্কার করেন। বিষ্ণু মন্দিরটি লক্ষ্মণ মন্দির নামে বিখ্যাত হয় লক্ষ্মণের ছোট কালো মূর্তির জন্য। এই মন্দিরটিই রানী বসটা স্বামী‌ মহাশিবগুপ্ত বালার্জুনের স্মৃতি রক্ষার্থে নির্মাণ করিয়েছিলেন।

লক্ষ্মণ মন্দিরের পাশেই ভারত সরকারের মিউজিয়াম। সিরপুরে খননের ফলে যে সব মূর্তি, স্থাপত্য পুনরুদ্ধার করা হয়েছে তাদের সযত্নে এই মিউজিয়ামে রাখা হয়েছে। স্থাপত্য শৈলী দেখলে মুগ্ধ হতে হয়। মহিষাসুরমর্দিনীর অপূর্ব সুন্দর এক মূর্তি, একদম অন‍্যরকম।

গাইডদাদা এরপর আমাদের নিয়ে গেল প্রাচীন বাজার অঞ্চলে। বিশাল অংশ খনন করে পাওয়া গেছে হরপ্পা, মহেঞ্জোদরো, ধোলাভিরার মতো চতুষ্কোণ করা ক্ষেত্র। এখানে নাকি বড় ব‍্যবসাকেন্দ্র ছিল। সুরাট, কটক-এর সঙ্গে ব‍্যবসায়িক আদান প্রদান হত। জায়গাটা খুবই সুন্দর। চারিদিকে আয়তাকারে কাটা ইটের প্রাচীর। দূরে দূরে বড় বড় গাছ। গাছে গাছে আগুনরাঙা ফুল। একটা গাছে প্রায় সাত আটটা হনুমান ফুল খাচ্ছে । জায়গাটায় দাঁড়িয়ে উপলব্ধি করছিলাম প্রাচীন ভারতের রূপকে। অতীতের হারিয়ে যাওয়া এক সমৃদ্ধ নগরীকে আজ মাটির তলা থেকে উদ্ধার করে আনার চেষ্টা চলছে। পুরাতন নগরীর উপর আধুনিক ভারতের গ্রাম‍্য জীবন চলমান। মানুষজনকে সরিয়ে সেই অতীতকে ফিরিয়ে আনা চাট্টিখানি কথা নয়। বর্তমান মানুষজন‌ই বা যাবে কোথায়? আর অতীত নগরীকে পুরোপুরি উদ্ধার করতেও সরকারের কোষাগারের উপর প্রবল চাপ পড়বে। তবু মানুষ চায় অতীতকে জানতে, কেমন ছিল আমাদের দূর অতীতের পূর্বপুরুষের জীবনধারা?

এরপরে আরও চমক ! কী অসাধারণ এই সুরংটিলা। সাদা পাথরে বানানো পাঁচটি মন্দির, অপূর্ব তার রূপ। বিকেলও হয়ে আসছে। বিদায়ী সূর্যের রক্তিম আভা সাদা পাথরের পাঁচটি মন্দিরের উপর মায়াময় রূপ ফুটিয়ে তুলেছে। ২০০৫-২০০৬ সালে সুরংটিলা মাটির গভীর থেকে উদ্ধার করে আনা হয়। প্রধান মন্দিরটি ৩৭ টি চুনাপাথরের খাড়া সিঁড়ি পেরিয়ে উচ্চতলে অবস্থিত। বলা হয় যে,  দ্বাদশ শতকে বিধ্বংসী ভূমিকম্প হয় এখানে। তার প্রত‍্যক্ষ প্রমাণ দেখলাম। সিঁড়ি চড়তে গিয়ে দেখা গেল, ভয়ানক ভাবে ট‍্যারাবাঁকা হয়ে আছে। সিঁড়ি চড়তে এবং নামতে রীতিমতো অভিযান করতে হল। উপরে উঠে মুগ্ধ হলাম এই কথাটাও খুব‌ই কম বলা হল। বাক‍্যহারা হয়ে গেলাম। মন্দিরটি বানানো হয়েছিল সপ্তম শতকে মহাশিবগুপ্ত বালার্জুনের দাক্ষিণ‍্যে। মন্দির স্থাপত‍্যের এক শৈলী হল পঞ্চায়তন। মূল মন্দির থাকে মাঝখানে আর তাকে ঘিরে চার কোণে সহায়ক চারটি মন্দির। এই সুরংটিলা‌র মধ‍্যিখানে মূল মন্দির এবং উত্তর‌পূর্ব, দক্ষিণ‌পূর্ব, দক্ষিণ পশ্চিম ও উত্তর পশ্চিমে বাকি চারটি মন্দির।  পাঁচটি মন্দিরের চারটি মন্দির শিবের উদ্দেশ‍্যে স্থাপিত। চারটি শিবলিঙ্গ চার রঙের — লাল, হলুদ, সাদা এবং কালো। বাকিটি গণেশ মূর্তির (হাতির মাথার গণেশ ঠাকুর) উদ্দেশে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। এখানে যে পাঁচটি মন্দির দেখলাম তার চূড়াগুলোতে বৌদ্ধ চৈত‍্যের স্থাপত্য। চৈত‍্যের মধ‍্যে মূর্তি আর তার উপর পশ্চিমের অস্ত যাওয়া সূর্যের রক্তিম আভা এসে পড়ছে। এক অদ্ভুত অনুভূতি‌তে মন আচ্ছন্ন হয়ে গেল। উপর থেকে চারিপাশ দেখতে খুব ভাল লাগছিল, নামতেই ইচ্ছে করছিল না। নীচের দিকে তাকাতে মাথাটা ঝিঝিম করে উঠল। এই বাঁকাচোরা খাড়া সিঁড়ি নামি কীভাবে? এ যে অভিযানের চূড়ান্ত পর্যায়। গাইডদাদার সহযোগিতা‌য় নীচে নেমে এলাম।

নীচে মন্দিরের ভগ্নাবশেষ এক বিশাল চত্বর জুড়ে।  এখানে ৩২টি ধ্বংসপ্রাপ্ত স্তম্ভ পাওয়া গেছে। এই চত্বরেই আবার তিনটি তান্ত্রিক মন্দিরের ধ্বংসাবশেষ পাওয়া গেছে: ব্রহ্মা, বিষ্ণু ও শিবের প্রতি উদ্দিষ্ট। আরও দুটো স্তম্ভের ধ্বংসাবশেষ দেখিয়ে গাইড‌দাদা জানালেন যে একটিতে পুরোহিতের বাসস্থান ও অন‍্যটি সন্ন্যাসী‌র।

লক্ষ্মণ মন্দিরের কাছেই রাম মন্দির। রাম মন্দির পাথরে নির্মিত উঁচু টিলার উপর অবস্থিত। এই মন্দিরটিও ২০০৩-২০০৪ সালে খননের ফলে আবিষ্কৃত হয়েছে। এটিও সপ্তম শতকে নির্মিত। এখানে যুগল মন্দিরের পরিকল্পনা ছিল। দুটি মন্দিরের একটিই ভগ্ন অবস্থায় পাওয়া গেছে। দ্বিতীয় মন্দিরের শুধু পরিকল্পিত রূপটিই পাওয়া গেছে। ভগ্নাবশিষ্ট মন্দিরটির  চাতাল ও মন্দির আছে কিন্তু মন্দির এবং গর্ভগৃহে‌র ছাদ সম্পূর্ণ ভাবে নষ্ট। স্তম্ভ গুলো ধ্বংসপ্রাপ্ত। কিছু কিছু ভগ্ন মূর্তিও পাওয়া যায়। খনন করে এখানে মাটির নীচে আরও তিনটে ঘর পাওয়া যায়। মনে করা হয় একটি পুরোহিতের ঘর, অন‍্যটি শস্যাগার। পুবমুখী যে অংশটি পাওয়া যায় সেটি শাঁখের চুড়ি বানানোর ঘর বলে মনে করা হয়। সেই ঘরে প্রচুর পরিমাণে শাঁখের চুড়ি, শাঁখ ও অর্ধসমাপ্ত চুড়ি পাওয়া গেছে। এই রাম মন্দিরের বৈশিষ্ট্য হল এটি দক্ষিণ কোশলে মন্দিরের পরম্পরার একটি প্রাচীন উদাহরণ। পরম্পরাটি হল তারার আকারে মন্দির নির্মাণ।

মনের মধ্যে অতীতের সিরপুরকে উত্তমরূপে উপলব্ধি করে রায়পুরে‌র উদ্দেশ‍্যে র‌ওয়ানা হলাম।

আমাদের ড্রাইভার শ্রবণকুমার হঠাৎ গাড়ি থামিয়ে দৌড়ে গেল সকালের সেই বাড়িটার দিকে। তারপর দেখি এক মধ‍্যবয়সী ভদ্রমহিলার হাত থেকে ব‍্যাগ নিয়ে বন্ধ দরজার সামনে দাঁড়াল। ভদ্রমহিলা দরজার তালা খুললেন। শ্রবণকুমার হাসিমুখে জানাল যে ইনিই শাশুড়ি। শাশুড়ি আর জামাই এর বয়সের বিশেষ তফাৎ চোখে পড়ল না। শ্বশ্রূমাতা আবার চায়ের নিমন্ত্রণ করলেন। দর্শনেই আমরা মুগ্ধ। আমন্ত্রণ রক্ষা করা আর সম্ভব হল না।

সিরপুরকে পিছনে ফেলে বর্তমান জগতের দিকে ধাবমান হলাম। একদিন হয়তো এই বর্তমান যুগটিও কালের গহ্বরে বিলীন হবে। বহু বহু বছর পরে হয়তো আবার আবিষ্কৃত হবে বর্তমান সময়ের  প্রমাণ।

তথ্য সূত্র:

(১) ‘আদিবাসীগঢ় ছত্তীশগঢ়’। লেখক, সুশীল গৌতম। প্রকাশন বিভাগ, সূচনা ঔর প্রসারণ মন্ত্রালয়, ভারত সরকার

(২) ছত্তিশগড় ট‍্যুরিজমের লিফলেট

(৩) গাইড মুখ-নিঃসৃত বাণী

(৪) গুগল

* কর্মী, ভারত সঞ্চার নিগম লিমিটেড (বি এস এন এল) এবং কনভারজেন্স-এর জার্মান লেভেল-১ কোর্সের শিক্ষিকা।

গন্ধেশ্বর মন্দিরের প্রাঙ্গণে। পাশেই মহানদী।
গন্ধেশ্বর মন্দির চত্বরে।
গন্ধেশ্বর মন্দির
মিউজিয়ামে রাখা খননের মাধ্যমে প্রাপ্ত মূর্তি
শুকিয়ে যাওয়া মহানদী
বুদ্ধ বিহারে
বুদ্ধ বিহারে
বুদ্ধ বিহারে
লক্ষ্মণ মন্দির
মন্দিরের গর্ভগৃহের প্রবেশদ্বারের উপর শায়িত বিষ্ণু।
লক্ষ্মণ মন্দির
লক্ষ্মণ মন্দিরে
মুহূর্তকে ক‍্যামেরায় বন্দি করার চেষ্টা
লক্ষ্মণ মন্দিরের প্রবেশ দ্বারে
সেযুগের বাজার
পুরোনো দিনের বাজার চত্বর। বসন্তের আগমন।  
আমাদের গাইডদাদা। বোঝাচ্ছিলেন বিভিন্ন জায়গা‌র সঙ্গে ব‍্যবসা বাণিজ্য ভালই চলত।
হনুমানেরা মহানন্দে গাছের ডালে বসে ফুল খাচ্ছে।
সুরং টিলার কিছু ছবি
সুরংটিলা‌র নীচের বিশাল চাতালে।
সেই সুরংটিলা থেকে নামার অভিযান।
সুরংটিলার সিঁড়ির নীচে আমরা সবাই।
সুরংটিলার পাঁচটি মন্দিরের একটি।
সুরংটিলা‌র উপরে চারটি শিবলিঙ্গের একটি।
সুরংটিলা‌য় হাতির মুখের গণেশ ঠাকুর।