আস্ত আকাশের গল্প
কৌশিকী রায়*
এই লেখাটি আই.এস.আই কলকাতা দ্বারা আয়োজিত নারী দিবস উপলক্ষ্যে প্রতিযোগিতায় প্রথম পুরস্কার প্রাপ্ত
সেদিন ট্রেনে শান্তার সঙ্গে দেখা হল। ও আমার অনেক দিনের বন্ধু, যদিও আজকাল দেখা-সাক্ষাৎ কমে গেছে। দোষ আমারই, এমন ভাবে জড়িয়ে পড়েছি যে কী বলব! কবে যে ছাড়া পাব! নাকি পাব না?
একথা-সেকথার পর শান্তা বলল, “জানিস, কাল ভাস্করদা’র সঙ্গে দেখা হয়েছিল”। শুনেই কেমন দম আটকে এল। মুখ দিয়ে বেরিয়ে গেল, “ হ্যাঁ রে, কিছু বলে ফেলিসনি তো”? “আরে না না, কিচ্ছু বলিনি”- শান্তা অভয় দিল- “ওসব তোকে ভাবতে হবে না। তুই তোর দিকটা সামলা”। বলতে-বলতেই ওর স্টেশন এসে গেল, ও নেমে গেল।
এর পরেরটাই আমার। অফিস টাইম, ট্রেনে ভীষণ ভিড়। তার মধ্যেও কানে ওই কথাটাই বাজতে লাগল। জানি তো, আমারটা আমাকেই সামলাতে হবে, আর সেটা আমি করতেও চাই। কিন্তু শ্বশুরবাড়ির থেকে লুকিয়ে কিছু করা যে মেয়েদের জীবনে কী কঠিন! সবসময় একটা ভয় – যদি ধরা পড়ে যাই! সঙ্গে হাজার বছরের পুরনো শিকলটা তো আছেই। সেটায় মাঝেমধ্যেই টান পড়ে, মনে হয়, আমি কি অন্যায় করছি? যদিও জানি এতে কোনো অন্যায় নেই, আমি কাউকে ঠকাচ্ছি না। নিজের মত করে ভাবতে চাওয়াটা অন্যায় কেন হবে?
ভাবতে-ভাবতে কখন যেন স্টেশন থেকে বেরিয়ে এসেছি। সামনেই রিকশা স্ট্যাণ্ড, কদিন আগেও এখান থেকে রিকশা নিতাম। এখন হেঁটেই যাই। যদিও স্টেশন থেকে আমার স্কুল একেবারে কাছে নয়, রিকশাতেই দশ মিনিট লাগে। হেঁটে যেতে কষ্টই হয়। কী আর করব! মাইনের বেশিটাই তো ইএমআই দিতেই চলে যাচ্ছে।
আমি কমলিনী, একটা প্রাইভেট হায়ার সেকেণ্ডারি স্কুলে বাংলা পড়াই। মাইনে তেমন বেশি কিছু না। খুব ভালো স্কুলগুলো বাদ দিলে ইদানীং প্রাইভেট স্কুলে স্যালারির কী অবস্থা সে ভুক্তভোগী মাত্রেই জানেন। তা হলেও আমার একার জন্য সেটা খারাপ ছিল না। কিন্তু সংসারের এটা-সেটাতেও প্রায়ই কিছু না-কিছু দিতে হয়। আমার বর ভাস্করের ব্যবসায় গণ্ডগোল লেগেই থাকে। ভাস্কর বা আমার শাশুড়ি এমনিতে আমার সঙ্গে বিশেষ কথা না বললেও টাকার দরকার পড়লে ঠিকই জানিয়ে দেয়।
শান্তা এবং আরো দু-একজন, যারা ব্যাপারটা কিছুটা জানে, তারা অবাক হয়। ভাবে, আমি দিই কেন? ইচ্ছে কি আমারই করে? কিন্তু কী করব? ঝগড়া-অশান্তি যতটা পারি এড়িয়ে যেতে চাই। আমার মা- বাবা অতি সাধারণ ভীতু মানুষ, এসব জটিলতা সহ্য করতে পারবে না। মেয়ে যদি শ্বশুরবাড়িতে অশান্তি করে বাড়ি চলে যায়, বাড়ির সবাই আঁতকে উঠবে। আর ডিভোর্স? সে চিন্তাও কল্পনার বাইরে। অমন যার বাপের বাড়ি তার কি স্বামী-শাশুড়িকে না বলার মুখ আছে? এখানেই এভাবেই থাকতে হবে। অন্তত এতদিন এটাই ভাবতাম।
আমার বিয়ে হয়েছে প্রায় দশবছর আগে। অনেক চেষ্টা করেও যখন সন্তান এল না, তখন সবাই আমার দিকেই আঙুল তুলেছিল। আমি নিজেও কি তুলিনি? বাইরের আক্রমণের থেকেও অসহ্য ছিল ভিতরের অপরাধবোধ। তারপর তো ডাক্তার দেখানো হল, জানা গেল যে আমার নয়, সমস্যাটা ভাস্করের। শীতকালের সেই শুরু।
তারপর থেকে এই চলছে। হয় ঝড়, নয় ঝড়ের আগের থমথমে শান্তি। তার মধ্যেই প্রতিদিনের পড়াশোনা কাজকর্ম, স্কুল যাওয়া সবকিছু। কাজের দিনগুলো তাও কেটে যায়, আমার ফিরতে- ফিরতে সন্ধে, শাশুড়ি সন্ধের পর ঘর থেকে বেরোন না। ভাস্কর কখন ফেরে জানি না, ওর কাছে চাবি থাকেই, নিজের মত ঢুকে যায়। সকালে আমি যখন বেরোই ওর ঘরের দরজা বন্ধ থাকে।
অসুবিধাটা হয় রবিবারগুলোয়। রবিবারে বাড়িটা কেমন ছোট হয়ে যায়, তিনটে মানুষের জায়গা হতে চায় না। দম বন্ধ হয়ে আসে। এইভাবে দম বন্ধ রেখেই কাটিয়ে দিয়েছি এতদিন, মনে করেছি যাওয়ার কোনো জায়গা নেই। এই গ্যাস চেম্বারের মত বাড়িতেই আমি সবচেয়ে বেশি নিরাপদ, এর বাইরে গেলেই পৃথিবী অজগরের মত গিলতে আসবে! কী অদ্ভুত আমাদের চিন্তা-ভাবনা!
লিখতে ভালোবাসতাম, এখনো বাসি। বেশি কিছু নয়, সারাদিন পর একটু কাগজ- কলম নিয়ে বসতে ইচ্ছে করে। না, কোথাও ছেপে বেরোয়নি কখনো, নিছকই নিভৃত ভালো-লাগা। বিয়ের পর চর্চাটা বন্ধই হয়ে গিয়েছিল, ইদানীং আবার একটু-আধটু শুরু করেছি। এমনিতে এখন বলতে গেলে ভালোই আছি। আশপাশের কেউই আমাকে পছন্দ করে না, দু-একজন বাদে যার সাথেই দেখা হয় তার থেকেই আমার জোটে হয় উপদেশ নয় অবহেলা, সব মিলিয়ে বেশ আছি।
মানে এতদিন ছিলাম। শুধু একটাই ভয় মাঝেমাঝে চেপে বসত, এভাবে আর কতদিন? ভাস্কর যদি ডিভোর্স চায়? কোথায় যাব? আর যদি নাও চায়, এভাবেই কি সারাটা জীবন শেষ হয়ে যাবে? ভাবতেই শরীর-মন সব বিদ্রোহ করে উঠত।
তাই এই ফ্ল্যাটটার খবর পেয়ে আর দেরি করিনি। জানতাম অনেক অসুবিধা, আমার রোজগার কম, জানাজানি হয়ে গেলে তুমুল অশান্তি হবে, সবই জানি, সবই জানতাম। কিন্তু তাও নিজের একটা ঠিকানার লোভ সামলাতে পারলাম না। নিজের ঘর, নিজের জন্য নিজের আশ্রয়। লৌকিকতা- সামাজিকতার বাইরে নিজের মত থাকা। এ আমার বহু দিনের স্বপ্ন। চিন্তা ছিল শুধু খরচ নিয়ে। ইএমআই দেওয়ার পর তো বিশেষ কিছু থাকত না। সবসময় ভয় করত, ভাস্কর বুঝি টাকা চেয়ে বসল! বুঝতে পারছিলাম বেশিদিন আটকাতে পারব না।
তবে সেটা এত তাড়াতাড়ি হবে বুঝিনি। সেদিন স্কুল থেকে সবে ফিরেছি, ভাস্কর এসে গেল। এসেই বলল, “কাল কোথায় গিয়েছিলে?” “ কোথায় আবার? স্কুলে ছাড়া আর যাবটা কোথায়?” “ তাই নাকি? কাল কৃষ্ণেন্দু তোমাকে ওদের অ্য।পার্টমেন্টে ঢুকতে দেখেছে। কার ফ্ল্যাটে গেছিলে?”
হাসি পেল। যত যাই হোক, আমি নিজের ফ্ল্যাটে যেতে পারি এটা বিশ্বাসযোগ্য নয় তার মানে। বৃথাই ভয় পেয়েছিলাম। ভাস্কর অনেক চেঁচামেচি করল। এতদিন এটাকেই ভয় পেয়ে এসেছি, অথচ, কী আশ্চর্য, যখন সেটা সত্যি ঘটল তখন কেমন যেন হাসি পেল!
কী হবে আমার? ডিভোর্স? হলে হবে! যদি ফ্ল্যাটের ইএমআই টানতে না পারি? তাহলে তো এ কূল ও যাবে ও কূল ও যাবে! গেলে যাবে! যত কমই মাইনে পাই, একটা ভাড়ার ঘর আর দুটো সেদ্ধ ভাত ঠিকই জুটিয়ে নিতে পারব। তবে আর ভয় কী? পৃথিবী এত বড়, এত তার সম্ভাবনা, কীসের জন্য আমি এতদিন গুটিয়ে ছিলাম! আজ প্রথম বার বুক ভরে প্রাণ ভরে শ্বাস নিলাম। অর্ধেক নয়, আস্ত একটা বিরাট আকাশের নিচে দাঁড়িয়ে।
* গবেষিকা, ইকোনমিক্স রিসার্চ ইউনিট, আই.এস.আই, কলকাতা।