আরণ্যষড্বিংশিকা – একটি সমীক্ষা

কবি সীতানাথ আচার্য ও তাঁর কাব্য সম্বন্ধে আলোচনা করতে গেলে রবি কবির সেই পংক্তিটি বার বার মনে পড়ে-

আমি পৃথিবীর কবি, যেথা তার যত ওঠে ধ্বনি

আমার বাঁশির সুরে সাড়া তার জাগিবে তখনি।’

         সত্যিই আচার্য কবির ‘দিবস বিভাবরী’ ভরে উঠেছে ‘সুরের গুরু’র অমূল্য, অবিশ্রান্ত এবং বিচিত্র দানে। সীতানাথের বাঁশীতে উঠেছে তাই নব নব তান, নতুন সুর, নতুন ছন্দ। ‘সৃষ্টি সুখের উল্লাসে’ মেতে উঠেছেন এই কবি বিচিত্র তাঁর কাব্যসম্ভার। কত কাব্যই না লিখেছেন সীতানাথ। সারস্বত চর্চায় যেহেতু সীতানাথ বৈচিত্র্যের সন্ধানী, তাই তাঁর কাব্য প্রবন্ধ সবকিছুই বিষয় বৈচিত্র্যে পূর্ণ। অন্যত্র বলেছি, ‘বিভিন্ন ধরণের কবিতা বা কাব্য রচনা করেছেন আচার্য কবি, কখনও গীতিকাব্য- গীতিকাব্যের মধ্যে কখনও রোমান্টিকতাই প্রধান, কখনও বা সমাজের সমস্যা বা রাজনৈতিক বা আর্থ-সামাজিক সমস্যা রয়েছে কেন্দ্রবিন্দুতে, কবিতার মধ্যে কখনও মূর্ত হয়ে উঠেছে দেশাত্মবোধ, জাতীয়তাবোধ, কখনও রূপকল্পের মধ্যে ফুটে উঠেছে জটিল ঘূর্ণাবর্ত সময়ের প্রতিচ্ছবি, কখনও বা কাল চেতনায় আক্রান্ত পেলব কবিমনে ধূমায়িত বহ্নির প্রতিচ্ছবি, কখনও বা জগতকে দেখছেন ধ্যানীর মত গম্ভীরভাবে শান্তভঙ্গীতে, আর কখনও জীবনযন্ত্রণায় ক্ষতবিক্ষত মানুষের জন্য ডুকরে কেঁদে উঠেছেন।’ (দ্রষ্টব্য- সীতানাথ আচার্য : কবি ও প্রাবন্ধিক, পৃঃ ১৫-১৬)

         দেশের প্রতি, মাটির প্রতি, দেশমাতৃকার প্রতি তাঁর নাড়ীর টান একাধিক কবিতায় প্রতিধ্বনিত হয়েছে- কখনও অভিধার আশ্রয়ে, কখনও লক্ষণা আর কখনও বা সরাসরি অভিধামূল বা লক্ষণামূল ধ্বনির আশ্রয়ে।

         একদিকে বর্তমানে পরিবেশ দূষণ অন্যদিকে ভারতীয় সংস্কৃতির মূল মন্ত্র পরিবেশরক্ষণ- পাশাপাশি তুলে ধরেছেন সীতানাথ তাঁর ‘আরণ্যষড্বিংশিকা’ কবিতাটির মাধ্যমে। ২৬টি শ্লোকের সমন্বয়ে রচিত এই কাব্যে প্রধানতঃ অনুষ্টুপ্ ছন্দ ব্যবহৃত হলেও ইন্দ্রবজ্রা, উপেন্দ্রবজ্রা প্রভৃতি ছন্দের অনবদ্য প্রয়োগ কুশলতাও লক্ষণীয়।

         অরণ্যদেবী অথবা অরণ্যমাতার কাছে মানবসভ্যতার ঋণ অপরিশোধ্য, চিরন্তন, অন্তহীন। মানবসমাজের শৈশব অতিবাহিত হয়েছে অরণ্যমাতার স্নেহসিক্ত কোলে। অরণ্যজননীর কোলে অবস্থিত সমাধিমগ্ন ঋতদ্রষ্টা ঋষিদের চিত্তে ঋক্মন্ত্র প্রতিভাত হয়েছে। সেখান থেকেই উত্থিত হয়েছে সামগীত।

‘মাতস্তবাঙ্কে বসতাং শুভে পুরা

সমাধিমাস্থায় বিশোধিতাত্মনাম্।

বিচিত্রবর্ণাঃ প্রতিভাসিতা ঋচ-

শ্চিত্তে মুনীনামভবং চ দুর্লভাঃ।।’

‘অরণ্য’-কে, প্রকৃতিকে এই যে মাতৃসম্বোধন, তাঁকে বার বার ‘বরাভয়প্রদে’ ‘প্রদূষণবিঘাতিকে’, ‘শুভঙ্করি’ ইত্যাদি নানা অর্থবহ বিশেষণে বিভূষিত করা- আমাদের মনে করিয়ে অথর্ববেদের ভূমিসূক্তের সেই মন্ত্র- ‘মাতা ভূমিঃ পুত্রো২হং পৃথিব্যাঃ’। সেই মায়েরই অঙ্গচ্ছেদনে তৎপর আমরা। সীমাহীন আমাদের নিষ্ঠুরতা। আমাদের কি মনে পড়ে না- আমাদের অর্থাৎ এই মানবসভ্যতার বাল্য অতিবাহিত হয়েছে এই অরণ্য- মায়েরই কোলে-

‘শৃণ্বতাং মধুরাং গীতিং

বিহগ কূজনাত্মিকাম্।

ব্যতীতং বাল্যমস্মাক-

মিতি ন স্মর্য্যতে২ধুনা।।’

অরণ্যের কোলেই আদিকাব্য রামায়ণ রচিত হয়েছে- ‘ধ্বন্যালোক’-কার বললেন-

‘কাব্যস্যাত্মা স এবার্থ

স্তথা চাদিকবেঃ পুরা।

ক্রৌঞ্চদ্বন্দ্ববিয়োগোত্থঃ

শোকঃ শ্লোকত্বমাগতঃ।।’

তারপর থেকে কূলপ্লাবিনী কাব্যধারা সহস্রদিকে ছড়িয়ে পড়েছে।

‘মাতস্তদীয়ায়তনে কদাচিৎ

স্নাতুং প্রযাতস্তমসাং স্রবন্তীম্।

মুনেশ্চ বল্মীকভবস্য চিত্তে

ছন্দো নবীনং স্ফুরিতং বভূব।।’

রঘুবংশের কবিও বললেন- ক্রন্দনরতা সীতার সামনে এসে দাঁড়ালেন সেই কবি কোন কবি? ‘নিষাদবিদ্ধন্ডজদর্শনোত্থঃ শ্লোকত্বমাপদ্যত যস্য শোকঃ’ – ব্যাধের বাণে বিদ্ধ ক্রৌঞ্চকে দেখে যাঁর শোক শ্লোক হয়ে প্রকাশ পেয়েছিল সেই কবি।

         কালিদাস, ভবভূতির কাব্যেও উপলব্ধ হয় অরণ্য প্রকৃতির শাশ্বত স্থান। অরণ্যদেবী, যে শকুন্তলাকে সযত্নে লালন করেছিলেন, তার পুত্র ভরতের নামেই চিহ্নিত হয়েছে আমাদের দেশ- ভারত। সীতানাথ কবি বলেছেন-

‘অরণ্যলক্ষ্মি! ত্বয়কাতিযত্নতঃ

শকুন্তলা নাম সুতা সুপালিতা।

পুরা সুতং যা যমসূত সাধ্বী

তস্যাখ্যয়া নঃ প্রথতে হি দেশঃ।।’

         প্রসঙ্গতঃ বলি, কালিদাসের কাব্যে এই অরণ্যপ্রকৃতি  মানবসমাজের থেকে পৃথক, কোন সত্তা নয়, তাই তারা মানুষের সুখে হাসে, মানুষের দুঃখে কাঁদে। সীতার করুণ ক্রন্দন শুনে তাই ময়ূরের নাচ থেমে যায়, গাছের ফুল ঝরে পড়ে, হরিণীরা মুখ থেকে কুশের গ্রাস ফেলে দেয়। সীতার বেদনায় সমব্যথী অরণ্যও আকুল হয়ে কাঁদে-

‘নৃত্যং ময়ূরাঃ কুসুমানি বৃক্ষা

দর্ভানুপাত্তান্ বিজহুর্হরিণ্যঃ।

তস্যাঃ প্রপন্নে সমদুঃখভাবম-

ত্যন্তমাসীদ্রুদিতং বনে২পি।।’

তপোবনলালিতা শকুন্তলার বিরহে তপোবনের কান্না আজও আমরা শুনতে পাই। কুমারসম্ভবেও একই প্রকৃতিপ্রেম মূর্ত হয়ে উঠেছে।

         আধুনিক কবি সীতানাথও ভোলেননি অরণ্যের আশ্রয়ে গড়ে ওঠা শান্তরসাস্পদ তপোবনগুলির কথা, ভোলেন নি এই তপোবনগুলিই ভারতের বিশিষ্ট সংস্কৃতির উদ্ভবস্থল। অরণ্যের প্রেরণাতেই ঋষিচিত্তে উদ্গত হয়েছিল ঔপনিষদিক দর্শনচিন্তা। দূষিত বাতাস আত্মসাৎ করে নীলকণ্ঠ স্বরূপা অরণ্যমাতা আমাদের নিয়ত রক্ষা করেছেন। কিন্তু সেসব আমরা ভুলে গেছি-

‘এতচ্চ সর্বং তব কর্মপূতং / প্রচ্যাবিতং ভাতি হৃদো২দ্য মানবৈঃ।’

         সীতানাথের প্রণাম যেন কবির ভাষায়-

‘ও আমার দেশের মাটি

তোমার পরে ঠেকাই মাথা।’

         ক্ষেমেন্দ্র তাঁর ‘সুবৃত্ততিলক’ গ্রন্হে বললেন- কাব্যে শৃঙ্গার, করুণ প্রভৃতি রসের অনুসারে এবং বর্ণ্য বিষয় অনুসারে ছন্দের প্রয়োগ করতে হবে। সীতানাথ তাই করেছেন। ‘শিশুযুবদুর্দৈববিলসিতম্’ কাব্যটির আলোচনা প্রসঙ্গে বলেছি, ক্ষেমেন্দ্র তাঁর সুবৃত্ততিলক গ্রন্থের দ্বিতীয় বিন্যাসে বলেছেন- ‘তস্মাদব্যভিচারেণ শ্রব্যতৈব গরীয়সী’। অনুষ্টুপ্ ছন্দের লক্ষণ প্রসঙ্গে বলেছেন- ‘অনুষ্টুপ্’ এর ক্ষেত্রে অনেক ভেদ দেখা যায়। যে লক্ষণ করা হয়েছে তার অনেক ব্যতিক্রমও দেখা যায়, কিন্তু শ্রব্যতা অর্থাৎ শ্রুতিমাধুর্যই বিশেষভাবে বিবেচ্য। আগেই বলেছি, আবার বলছি সীতানাথের হাতে অনুষ্টুপ্ প্রয়োগের স্বচ্ছন্দতা, সাবলীলতার কথা। জানা বিষয়ের পুনরুক্তির অর্থ ছন্দঃপ্রয়োগে কবির বৈদগ্ধ্যের, মুন্সীয়ানার আত্যন্তিক গুরুত্বটুকু পাঠকের সামনে তুলে ধরা। আরণ্যষড্বিংশিকা-র বিশেষ বিশেষ অংশে অনবদ্য অনুষ্টুপ্। তাছাড়াও এখানে ওখানে বন্দনাগাথা অথবা প্রশস্তিপত্র অথবা অভিনন্দন পত্রের ছত্রে ছত্রে রয়েছে সীতানাথের অনুষ্টুপ্। বারবার মনে হয়েছে- ‘সুবশা সীতানাথস্য অনুষ্টুপ্ প্রবল্গতি।’

         ছোট্ট কবিতার মধ্য দিয়ে কবি সীতানাথের পাশাপাশি দার্শনিক ও বৈয়াকরণ সীতানাথও বারবার আত্মপ্রকাশ করেছেন। ৯নং শ্লোকে ‘প্রয়াতঃ’ শব্দটি ‘মুনেঃ’ এর বিশেষণ রূপে প্রযুক্ত। আপতঃদৃষ্টিতে মনে হয় ‘ক্ত’-প্রত্যয়ান্ত শব্দ, কিন্তু প্রকৃতপক্ষে প্রয়াত্ শব্দের ষষ্ঠীর একবচনে নিষ্পন্ন- সেই মুনির চিত্তে ‘স্ফুরিত’ হয়েছিল। কোন মুনির- যিনি তমসার স্নানের উদ্দেশ্যে গমন করেছিলেন, যিনি ‘বল্মীকভব’।  ‘নদী’ অর্থে ‘স্রবন্তী’ পদের প্রয়োগও প্রশংসার দাবী রাখে। প্রাসঙ্গিক সেই শ্লোক-

‘মাতস্তদীয়ায়তনে কদাচিত্

স্নাতুং প্রযাতস্তমসাং স্রবন্তীম্।

মুনেশ্চ বল্মীকভবস্য চিত্তে

ছন্দো নবীনং স্ফুরিতং বভূব।।’

শব্দ প্রয়োগে আচার্য কবির মুন্সীয়ানা বার বার উপলব্ধ হয়েছে ‘আরণ্যষড্বিংশিকা’ কবিতায়। সম্যক্ স্থিতি অর্থে সংস্থান’ (১), ‘প্রফুল্লত্’ শব্দের ষষ্ঠীর একবচনে ‘প্রফুল্লতাম্’ (৪) ইত্যাদি প্রয়োগ বিশেষভাবে প্রণিধানযোগ্য।

         যমক অনুপ্রাসের সব ভেদ- বৃত্ত্যনুপ্রাস, শ্রুত্যনুপ্রাস ইত্যাদির স্বচ্ছন্দ ও সাবলীল প্রয়োগ পাঠককে মুগ্ধ করে। ‘পুরা সুতং সা যমসূত সাধ্বী’ (১২), ‘বিধীয়তাং বুদ্ধিবিশুদ্ধা’ (২৫) ‘… চরিতৈঃ কিলৈতৈঃ’ (২০) ‘ক্লেশততিং ততানা’ (২০), ‘বৃত্তির্বিনিন্দিতা’ (৩), ‘কিঞ্চিত্ কদাপি কৃপয়া’ (২১) ইত্যাদি অবশ্যই উল্লেখনীয়।

         কবিতার শেষ দুটি শ্লোক কবি বিধাতার কাছে মানুষের শুভবুদ্ধির কামনা করছেন- মানুষ যেন আবার অরণ্যসৃজনে উদ্যোগী হয়- ‘উচ্ছেদতো২রণ্যভুবো২চিরেণ নিবর্তিতাঃ স্যাম যথা চিরেণ’, এবং ‘স্বচ্ছন্দতঃ প্রতিগৃহং প্রতিভূমিভাগং সংরোপ্য বৃক্ষনিচয়ান্ পরিপালয়েম’ (২৫, ২৬)। সেই শুভবুদ্ধির প্রেরণায় রবি কবির সুরে সুরে মিলিয়ে বলছেন- ‘দাও ফিরে সে অরণ্য- লও এ নগর’।

         রাজানক কুন্তকাচার্য এবং তাঁর বক্রেক্তিতত্ত্ব সীতানাথ আচার্যের সারস্বত সাধনার অন্বিষ্ট। সেই কুন্তকের ভাষায় বলি- ‘ন কাব্যার্থবিরামো২স্তি যদি স্যাৎ প্রতিভাগুণঃ।’ প্রতিভা শক্তি যদি থাকে তবে কাব্যার্থের বিশ্রান্তি হয় না অর্থাৎ নানা প্রকার কাব্যার্থের নিয়ত স্ফুরণ ঘটে। সবশেষে এই প্রার্থনা, বিরল কবিপ্রতিভার আধার সীতানাথ কবির কলনাদিনী কাব্যধারা বয়ে চলুক স্বচ্ছতোয়া স্রোতস্বিনীর মত, অনাবিলা নির্ঝরিণীর মত।**

** উক্ত প্রবন্ধটি ‘UGC Sponsored State Level Seminar on Village and Forest Life in Sanskrit Literature এই সেমিনার প্রসেডিং থেকে পুনর্মুদ্রিত, পৃ. ৪।